ভক্তকে লেখা প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ে একটি চিঠি। চিঠির তারিখ ৪ঠা জুলাই ১৯৬৩। ততদিনে দেশ ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু সাহিত্যিক ও সাহিত্যানুরাগীদের বন্ধনে চিড় ধরেনি। চিঠিটিই তার সুন্দর প্রমাণ। চিঠির প্রাপক আমিনা বেগম (লুসী)।চিঠি থেকে অনুমান করা যায় তার বাড়ি সম্ভবত চট্টগ্রামে ছিল । আমিনা বেগম ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
চিঠিটি আমিনা বেগমের মেয়ের স্বামী কবির জামির সৌজন্যে পাওয়া। চিঠির একটি পাঠ ছবির নিচে দেওয়া হল।
সুচরিতাসু,
ভক্তি ভাজনেষু- সম্বোধনের উত্তরে ‘তুমি’ লিখলে কি রুষ্ট বা ক্ষুব্ধ হবে? সম্ভবত হবেনা। হলেও মার্জনা পেতে দেরী হবেনা। কারন আমি জানি- আমি বঙ্গভাষাভাষীর স্নেহভাজন। তাছাড়া বাপ মেয়েকে তুমি বলে, ছেলে মাকে তুমি বলে।
ভারী ভাল লাগল তোমার পত্র। সুচিন্তিত পত্র। একটি অতিসূক্ষ রসবিচারের পরিচয় আছে। বই পড়ে, মনে স্বপ্ন সঞ্চার- শুধু লেখকের দ্বারা হয়না- পাঠকের মন চাই। বীজের অঙ্কুর ঊষর মাটিতে হয়না- উর্বর ক্ষেত্রেই সম্ভব।
কথাটা বা প্রশ্নটি ঠিকই তুলেছ। রামায়ণের রাম বাস্তবে ছিলেন কিনা- বা কেমন ছিলেন- এ আলোচনা- মহাকাব্যের রমণীয় মূর্তিটির উপর একটি কালো ছায়া ফেলে ম্লান করে দেয়। মহাকাব্যের অপরূপ মূর্তিটিই এ ক্ষেত্রে সত্য, বাস্তবই মিথ্যা। এই অপরূপ কায়াগুলির ছায়াও পড়েনা- সুতরাং- মাটির বুকে ছায়ার মতও পড়ে থাকার তার অধিকার নেই।
ব্যাপারটা ঘটেছিল- বহুজনের প্রশ্ন থেকে। বহু মানুষের বহু বিচিত্র মন। তারা অবিরাম জানতে চেয়েছিল- এই কাহিনী ও কাহিনীর চরিত্রগুলির কতটা বা কতদূর সত্য। এক শ্রেণীর তথ্য কৌতুহলী আছেন। তাদের মনে রসের চেয়ে রসগোল্লার ছানার ক্ষুধা বড়। তোমার মনটি- শিশিরগ্রাহী তৃণশীর্ষের মত পেলব- অথবা পুষ্প দলের মত কোমল। হয়তো সহজাত। অন্যথায় স্বপ্নে তুষ্ট থাকতে পারতে না। বাস্তবে কত দূর সত্য তা জেনে বিচার করতে বসতে আমি কতটা রোমান্টিক।
আগামী সংস্করণে এটি তুলে দেব। এবং- তোমার অনুমতি বা সম্মতি পেলে- পত্রখানি ভূমিকার অন্তর্গত করে দেব।
পরিশেষে প্রশ্ন তোমার নাম লুসী কেন? আমার কল্যাণ কামনা আশীর্ব্বাদ গ্রহণ কর। চট্টগ্রামে যে দারুণ প্রাকৃতিক দূর্যোগ গেল তা থেকে নিরাপদ আছ- এর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই। যারা আহত হয়েছেন- ক্ষতিগ্রস্থ শোকাহত হয়েছেন- তোমার মারফতে তাঁদের জন্য আমার অন্তরের বেদনা ও সহানুভুতি জানাই।
তোমার পত্রখানি সযত্নে রক্ষা করলাম।
শুভার্থী
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়