লেখক: শ্রী দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য
১৬৬৬ খ্রীষ্টিয় সনে বাঙ্গলার বিখ্যাত নবাব সায়েস্তা খাঁ চাটিগ্রাম জয় করিয়া মঘ-ফিরিঙ্গিদের চরম শাস্তি বিধান করেন এবং বাঙ্গালী জনসাধারণ প্রায় অর্ধশতাব্দী ব্যাপী দারুণ অত্যাচার হইতে রক্ষা পাইয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচে। চল্লিশ বংসর পূর্বে শ্রদ্ধেয় যদুনাথ সরকার মহাশয় পারস্য-
ভাষায় লিখিত প্রামাণিক ইতিহাস হইতে চাঁটিগাঁ বিজয় ও চাঁটগার ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের বিবরণ প্রকাশ করেন।( J.A.S.B, 1907, pp. 405-425) কিন্তু বাঙ্গলার ইতিহাসের এই তমশাচ্ছন্ন যুগের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এখনও লিখিত হয় নাই । কারণ, মঘদৌরাত্ম্যের সুদীর্ঘকাল ব্যাপী ঝটিকা নিম্নবঙ্গের প্রায় ঘরে ঘরে যে করুণ অবস্থার সৃ্ষ্টি করিয়াছিল রাজদরবারে তাহার প্রকৃত বৃত্তান্ত পৌঁছিবার অবসর পায় নাই এবং অধিকাংশ স্থলে প্রজার বিলোল ক্রন্দনধ্বনি আকাশে সাময়িক তরঙ্গ তুলিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছে, কচিৎ তাহার স্মৃতি তৎকালীন সমাজ-হৃদয়ে জাগরুক থাকিতে সমর্থ হইয়াছে। এ
বিষয়ে আমদের সংগৃহীত অজ্ঞাতপূর্ব কতিপয় ছিন্নপত্রের বিবরণ প্রকাশ করার পুর্বে মঘদৌরাত্মের উৎপত্তির বিচিত্র ইতিহাস সংক্ষেপে বিবৃত হইল।
পাঠান রাজত্বকালে চাটিগ্রামের আধিপত্য লইয়া চতু:শক্তির সংঘর্ষ উপস্থিত হ্য়–পাঠান, আরাকান, ত্রিপুরা ও ফিরিঙ্গি। সোনারগাঁর সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৯-৪৯ খ্রী:) সর্বপ্রথম চাটিগাম জয় করেন। তাহার সময়ে অনেক ধর্ম্মমন্দিরাদি চাটিগামে নির্মিত হইয়াছিল এবং
তাহাদের ধ্বংসাবশেষ সায়েস্তা খাঁর সময় বিদ্যমান ছিল। ( J.A.S.B, 1907, pp. 4২১) তখন হইতে চাটিগ্রাম বাঙ্গলার পাঠান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এবং কালে চাটিগ্রামে একটি টঙ্কশালাও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। দনুজমর্দ্দনদেব, মহেন্দ্রদেব ও জালালুদ্দীনের চাটিগ্রামী মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে (Bhattashali: Independent Sultans of Bengal, pp. 119, 123-5) ইহাদের তারিখ ১৪১৭-২০ সন মধ্যে। দশ বংসর পরে পলায়িত আরাকানরাজ ‘মেঙ ছৌ-মুন’ গৌড়ের সুলতানের আশ্রয়ে চব্বিশ বৎসর থাকিয়া তাহার সাহায্যে রাজ্যেদ্ধার করেন – ইহা জালালুদ্দীনের রাজত্বকালীন ঘটনা।
আরাকানের ইতিহাসে পাওয় যায় ৭৬৮ মঘী সনে (১৪০৬ খ্রী:) ঐ রাজা তৎকালীন চাটিগ্রামের উজীরের সাহায্যে গৌড়সুলতানের আশ্রয় লাভ করেন । আরাকান-চাটগ্রাম-সম্বাদের ইহাই প্রথম সুত্রপাত | চাটিগামের ইতিহাসের এই তমসাচ্ছ্ন যুগের একমাত্র আলোকদাতা হুইল আরাকানী ভাষায় লিখিত আরাকানের ইতিহাস গ্রন্থ এবং শতাধিক বর্ষ পুর্বে ১৮৪৪ সনে ফেয়র (Phayre) সাহেব তাহা হইতে যে অতি সংক্ষিপ্ত সারসংকলন করিয়াছিলেন তদতিরিক্ত কোন কথাই এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নাই। পনের বৎসর পুর্বে রেঙ্গুনে প্রকাশিত আরাকানের বিস্তৃত ইতিহাসের দ্বিতীয় খণ্ডে (পৃ. ৪১৫) পাঠানযুগ হইতে বর্তমানকাল পযন্ত বিবরণ সংগৃহীত পাওয়া যায়। ছ্ন্দ-মালাকার রচিত ১২৯৩ বর্মাব্দে প্রকাশিত “রখইঙ, রাজওয়াঙ, খহ-ক্যাম” অর্থাং আরাকানের নুতন ইতিহাস আমরা সংগ্রহ করিয়াছি এবং তন্মধ্যে বহু নুতন কথা আবিষ্কৃত হইয়াছে | আরাকান রাজ-গণ পরে ক্রমশ চাটিগ্রামে অধিকার বিস্তার করিলেও রাজা-উজীরের এই সামান্য সংঘর্ষে প্রজাসাধারণের শান্তিভঙ্গ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না। গৌড়সুলতানের প্রতিভু চাটিগ্রামের উজীরগণ অবাধে আরাকানের আদান-প্রদান চালাইয়া আত্ম-রক্ষা করিয়াছে সন্দেহ নাই।