মুল্লুকে চলো: চা শ্রমিক আন্দোলনের শতবর্ষ

মোহন রবিদাস
আজ ২০ মে ঐতিহাসিক “চা-শ্রমিক হত্যা দিবস”। ব্রিটিশদের মিথ্যা প্রলোভনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা (১৮৩৪-৩৫ সালে)চা শ্রমিকরা ব্রিটিশ চা-বাগানমালিক কর্তৃক অত্যাচার-নিপীড়ন,অবহেলা-নির্যাতন সইতে না পেরে ১৯২১ সালের এই দিনে নিজ মুল্লুকে (আবাসভূমিতে) ফিরে যাবার জন্য “মুল্লুকে চলো আন্দোলন” সংগঠিত করেছিল।
যেহেতু তাদের কাছে কোন টাকা-পয়সা ছিল না তাই পায়ে হেঁটেই সিলেট থেকে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাঁটে পর্যন্ত আসে। এখানে ব্রিটিশরা তাদেরকে বাঁধা দেয়।
বাঁধা অতিক্রম করে চা-শ্রমিকরা মেঘনা নদী পার হয়ে নিজের মুল্লুকে যেতে চাইলে এ ব্রিটিশ গুর্খা বাহিনী তাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং হাজার হাজার চা-শ্রমিককে পেট কেটে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে।
চা-শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয় মেঘনা নদীর পানি। চা-শ্রমিকদের রক্তেমাখা এই ইতিহাসকে স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর পালিত হয় ২০ মে পালিত হয় “চা-শ্রমিক হত্যা দিবস”।
প্রসঙ্গত, ইংরেজরা অতি কৌশলের মাধ্যমে কম দামে শ্রম কিনে যাতে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায় সেই লক্ষ্যে আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে (গাছ হিলায়ে গা তো পাইসা মিলেবে- গাছ নাড়লে টাকা মিলবে)১৮৩৪ সালের দিকে ভারতের বিহার, মাদ্রাজ,উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কানু,তেলেগু, লোহার,রবিদাস,গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করে।
কিন্তু চা-শ্রমিকরা এ অঞ্চলে এসে দেখে গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা হিংস্র জীব-জন্তুর প্রতিকূল পাহাড়-জঙ্গলময় পরিবেশে নিজের জীবন বাঁচানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার।
অনাহারে-অর্ধাহারে,অসুখে-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন হয়েছে তাঁরা। সে সময় আড়কাঠি ও গিরমিট প্রথার কারনে চা ম্যানেজার এই অসহায় মানুষগুলোর উপর একচ্ছত্র নির্যাতন করার অধিকার পায়।
কোন শ্রমিক ইচ্ছে করলেই চাকরি থেকে ইস্তোফা দিতে পারতো না। বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাদের ধরে আনা হতো। দেয়া হতো আমানবিক শাস্তি যা অপরাধ হিসেবে গন্য হতো না।
চাবুক বুটের লাথি ছিল এই নিরীহ মানুষগুলোর নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এভাবে মালিকদের হাতে শ্রমিকের মৃত্যুকেও সাধারণ ঘটনা হিসবে দেখা হতো। মালিকদের কথাই সেখানে রাষ্ট্রিয় আদেশ হিসেবে গণ্য হতো। শ্রমিকদের ইচ্ছা আনিচ্ছা বলতো কোন কিছু কল্পনাই করা যেতনা।

বাগানের ভিতরে ছাতা মাথায় হাটাও আপরাধ হিসেব গন্য হতো। পুরুষ শ্রমিকদের বেতন চার আনা,মহিলাদের বেতন তিন আনা এবং শিশুদের বেতন দুই আনা। তখন চা বাগানে শিশু শ্রম বৈধ ছিল (যা বর্তমানেও আছে) কি পরিহাস! এই ইংরেজরা কৃতদাস প্রথা বাদ দিয়ে চালু করে এমনই বিভৎস আইন।
ওলন্দাজ বণিকরা ১৬১০ সালে প্রথম চীন থেকে চা আমাদনি শুরু করে।ইংরেজরা প্রথম চা আমদানি করতো চীন থেকে। চীন জাপান যুদ্ধের কারনে চীনের সাথে সম্পর্ক আবনতি হলে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।
ইংরেজরা বিকল্প চা উৎপাদনের জন্য তাদের ভারতবর্ষের উপর নজর পড়ে। ১৮৩৫ সালে বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। তার নাম “রয়েল সোসাইটি” ভারতবর্ষে চা উৎপাদনের করার জন্য অনুসন্ধান করাই এই কমিশনের কাজ।
এই কমিটি কাজ শুরু করার আগেই শিলচর এবং করিমগঞ্জে চা গাছের সন্ধান পাওয়া এই বছরই প্রথম চীনের বাইরে বাণিজ্যিক ভাবে চা এর উৎপাদন কার্যক্রম গ্রহন করা হয়।
১৮৩৮ সালে সিলেট ও কাছাড়ে পরীক্ষামূলক ভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। ভারতবর্ষে আসামের লখিমপুরে, সিলেট ও কাছাড় জেলায় চা এর উৎপাদন ব্যাপকতা পায়।
চা শিল্প যেহেতু শ্রমঘন শিল্প। চা বাগান গড়ে তুলতে প্রচুর শ্রমিকের দরকার হয়। পাহাড়ি জঙ্গল পরিস্কার করা,রাস্তাঘাট নির্মাণ গৃহ নির্মাণ করা প্রাথমিক কাজ। তাছাড়াও দ্রুত বর্ধণশীল আগাছা নিয়মিত পরিস্কার করতে দরকার হয় অনেক শ্রমিক।

আসামে ১৮২৬ সালে লোকসংখ্যা প্রতিবর্গমাইলে ৯জন এবং ১৮৫৩ তা বেড়ে হয় প্রতিবর্গমাইলে ৩০জন। সেই সময়ে আসামের সকল প্রাপ্তবয়স্ক লোক দিয়েও তার চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিলনা।
সিলেটে ১৮৫৩ সালে লোক সংখ্যা ছিল প্রতিবর্গমাইলে ২০০জন।এ ছাড়া ও আসাম বা সিলেটের মানুষ চা বাগানে কাজ করাকে অসম্মান মনে করায় তারা কাজ করতে অনাগ্রহী ছিল।
চা বাগান করতে হলে লোকজন তো লাগবেই।সহজ উপায়ে শ্রমিক সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে, শুরু করে লোক সংগ্রহের অনৈতিক কর্মকান্ড। স্থানীয় জনগণকে কাজে লাগানোর জন্য ১৮৩৪ সালে উল্লেখ যোগ্য দুটি পদক্ষেপ নেয়।
এক ক্রীতদাস প্রথা বিলোপ্ত করণ এবং কৃষকদের খামারে উচ্চ হারে কর আরোপ। এমনকি পান সুপারির উপরও কর আরোপ করে। তবু শ্রমিক সংগ্রহের ক্ষেত্রে তা খুব প্রভাব ফেলতে পারেনা।
চা রপ্তানির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ১৮৬৪–৬৫ সালে রেল লাইন স্থাপন করে এবং প্রসারিত করে ১৯০৪ সালে চটগ্রামের সাথে সংযুক্ত করে। এই কারনে স্থানীয় শ্রমিকদের তোষামোদের চেয়ে বাহির থেকে শ্রমিক আমদানি অনেক সহজ হয়ে যায়।
তাই বলেই তো শ্রমিকরা রেল চেপে চা বাগানে কাজ করতে আসবার কোন কারন নাই। সেই সময়ে শ্রমিক বলতে মূলত কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রমিকেই বোঝানো হত। তখন মালয়েশিয়া এবং পশ্চিম ভারতের দ্বীপ পুঞ্জে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রপ্তানি করা হতো।
চা করেরা এই তথ্য অবগত থাকায় নতুন করে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের টোপ ফেলে।
বিহারের রাঁচী, হাজারিবাগ, সাঁওতাল পরগণা, ডুমকা ও গয়া, উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ, গঞ্জাম,সম্বলপুর ও চাইবাসা এবং মধ্য প্রদেশের রায়পুর, রামপুরহাট ও জব্বলপুর প্রভৃতি জেলা থেকে মূখ্যত শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়।
এ ছাড়াও উত্তর প্রদেশ,পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি প্রদেশ থেকেও শ্রমিক সংগ্রহ করার হয়। নেপাল থেকেও এক পর্যায়ে শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়।
১৮৪১ সালের দিকে শ্রমিক প্রেরণ কার্যক্রম বেগবান করার জন্য“ফ্রি কনট্রাক্টরস” পদ্ধতি তৈরি করে। এই আইনের বলে বড় অংকের টাকার বিনিময়ে কুলি সংগ্রহ করার জন্য চা–করেরা চুক্তি করেন স্থানীয় এজেন্টদের সাথে।
লোভী এজেন্টরা ( এদেরকেই আড়কাঠি বলা হয়,এবং এই প্রক্রীয়াই আড়কাঠি আইন।) স্থানীয় কিছু ধুর্ত লোককে আড়কাঠি হিসেবে বাছাই করে।
তারা অধিক মুনাফার আশায় নিজেদের মধ্যে শুরু করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। শ্রমিকদের দেখাতে থাকে নানান প্রলোভন। করতে থাকেন নানা রকমের মিথ্যাচার।
তারা গ্রামে গ্রামে সুসজ্জিত বেশে গিয়ে চা শ্রমিকদের সুখের জীবন ফুলিয়ে,ফাঁপিয়ে,বানিয়ে বলত। বলা হতো, চা-বাগানে নাড়ালে টাকা পড়ে। গরিব গৃহস্থের ছেলেমেয়েরা এসব শুনে সুখের স্বপ্ন দেখতো।
তার পর ঐ আড়কাঠির হাত ধরে একদিন বাড়ি ছেড়ে পা বাড়াত। ছাগল গরুর ব্যবসার মতো শ্রমিক সংগ্রহের ব্যবসা তখন জমজমাট। কোন ভাবে তাদের জাহাজের ঘাটে এনে দিতে পারলেই হাতে পেত কচকচে টাকা।
আড়কাঠিদের কাজ হচ্ছে কুলিদের জাহাজ ডিপোয় এনে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া ।একবার স্বাক্ষর করাতে পারলেই চা মালিকদের জিম্মায় চলে যেত। ততক্ষন পর্যন্ত তাদের আদর আপ্যায়ন ভালই হতো।
হাত বদলে তারা এসে পড়তো জাহাজের কতৃপক্ষের কাছে।শুরু হতো তাদের উপর অমানবিক আচরণ। কুলিদের জন্য তো আর জাহাজের বাড়তি যোগান দেয়া যাবে না তাই ছাগল গরুর মতো তাদের জাহাজে উঠানো শুরু হল। জাহাজের ধারন ক্ষমতা যেখানে ২০০ জন সেখানে তোলা হতো ১০০০–১২০০ জন ।
মুল্লুকে চলো আন্দোলন
মুল্লুকে চলো আন্দোলন – চা শ্রমিক
শুয়ে থাকা তো দুরের কথা বসবার মতোও কোন স্থান ছিলনা। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাদের দিন কাটাতে হতো। খাওয়া দেওয়া হতো খুবই কম,যে টুকো খাবার না দিলেই নয়।
জাহাজে ভ্রমনের ধাক্কার সাথে যোগ হতো রোগবালাই।কলেরা বসন্ত মহামারি রুপে দেখা দিল। তাদের জন্য জাহাজে কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজনীয়তা কেউ মনে করেনি। কাতারে কাতারে লোক জাহাজে মারা যেত।
জাহাজ এসে ভিড়ল বদরপুর বা কাঠিগড়ায়(পূর্বে এই দুটিই ছিল জাহাজ বন্দর)।জাহাজ যখন খালাস করা হচ্ছিল তখন অর্ধেক জীবন্তু এবং অর্ধেক নামছে লাশ হয়ে।
রোগ বিস্তারের অজুহাতে লাশ গুলো ফেলে দেয়া হতো পানিতে। চোখের সামনে দেখতো সৎকার বিহীন ভাই,বাবা,চাচা,বন্ধুর লাশ পানিতে ফেলা হচ্ছে ঝুপ–ঝাপ শব্দ করে।
যারা বেঁচে থাকল তাদের নিয়ে আসা হল শ্বাপদ সংকুল জঙ্গলে। যে সুখের দিনের কথা তারা চিন্তা করে জাহাজে উঠেছিল তা খুব দ্রুতই মিলিয়ে যেতে লাগল।
জঙ্গলেই তাদের থাকতে হবে। এখানেই কাজ করতে হবে। মারতে হবে সাপ,বাঘ,ভাল্লুক, হাতি, বিষাক্ত পোকামাকর আথবা তাদের হাতেই হবে তাদের মৃত্যু। জীবজন্তুর সাথে এবং জঙ্গলের সাথে লড়াই করে কমে যেতে থাকে তাদের সংখ্যা।
ম্যালেরিয়া,কালা জ্বর তাদের নিত্য সঙ্গী। চিকিৎসা বলতে কোন ব্যাপার তখন শ্রমিকদের জন্য ছিলনা।এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে চা চাষের জন্য ১৮৬৩-১৮৬৬ সালে এ অঞ্চলে ৮৪,৯১৫ শ্রমিক আনা হয় যার মধ্যে অনাহারে-অর্ধাহারে,অসুখে-বিসুখে ৩০,০০০ শ্রমিক মারা যান Griffiths(1967-70)।
আধিকাংশ চা বাগানের মালিকই তখন বৃটিশ কোম্পানি। ভারতবর্ষে তখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বাধতে শুরু করে। এই আন্দোনলের কিছুটা বাতাস পায় চা শ্রমিকরাও।
ক্ষুধা,রুগ ভোগ,মৃত্যু, নিজ আপনজন থেকে দূরে থাকা, এবং আদৌ ফিরে যাবার অনিশ্চয়তা তাদের বিদ্রোহী করে তোলে।
তখন ১৯২০ সাল। শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাগান থেকে বাগানে। বিদেশি মালিকদের সব রকমের ব্যবসা বাণিজ্যে ও চা বাগান বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।
রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো শ্রমিক আন্দোলনের হাল ধরার মতো বলতে গেলে কেউ ছিলনা। অদক্ষ ভাবে আন্দোলন গড়াতে থাকে। রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে তারাও চা বগান থেকে বের হয়ে আসে।
১৯২১ সালে ব্রিটিশ–বিরোধী আন্দোলন ও গণজাগরণ চা শ্রমিকদের অনুপ্রাণিত করে। এ সময় থেকে চা শ্রমিকদের শোষণ–বিরোধী সংগ্রাম সম্রাজ্যবাদ–বিরোধী জাতীয় শক্তি সংগ্রামের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
চরগুলা অঞ্চলের চা–শ্রমিকগণ ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে চা বাগান থেকে বের হয়ে স্ত্রী,পুত্র,পরিজন, নিয়ে রেলপথ ধরে হাঁটতে থাকে। এ চা শ্রমিক আন্দোলনকে চরগোলা এক্রডাস বলা হয়।
সিলেট ও কাছাড়ের প্রায় ত্রিশ হাজার চা–শ্রমিক এ অন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তাদের দাবি ছিল একটি – ইংরেজ মালিকেদর অধীনে কাজ করবেন না। তাদের নিজের আবাসভূমিতে (মুল্লুকে) ফিরে যাবে।
১৯২১ সালের ৩ মার্চ অনিপুর চা বগান থেকে ৭৫০ জন শ্রমিক বেরিয়ে আসলে শ্রমিকদের মধ্যে বাগান ছাড়ার তৎপরতা দেখা যায়।দলে দলে শ্রমিকরা বাগান থেকে বের হতে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই নিজের মুল্লুকে ফিরে যাবে।
সেসময়কার অসহযোগ আন্দোলন তাদেরকে পুরনো গ্রামের সেই কথা আবার মনে করিয়ে দেয়। চা-শ্রমিকরা বুঝতে পারে, চা মালিকরা তাদের প্রতারণা করে জঙ্গলে বন্দি করে রেখেছে।
তাদের সোনালী অতীতে ফিরে যাওয়ার বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস অনুভব করে। পাগলের মতো কোন চিন্তা না করে বেরিয়ে যায় মাথা গোজার ঠাঁই ছেড়ে। কি ভাবে যাবে? কি খাবে? এসব চিন্তা তাদের একটি বারের জন্যও থামাতে পারে না। তারা বেরিয়ে পড়ে অজানার গন্তব্যে।
কি হবে আর থেকে এখানেও তো ধুকে ধুকে মরছি তো একবার বেরিয়ে দেখি না কি হয়। বন্দি জীবনের কারনে তাদের বাহিরের পৃথিবীটাও ছিল অপরিচিত। এই অপরিচিত পৃথিবী থেকে বেরিয়ে আসে স্ত্রী,পুত্র, কন্যার হাত ধরে। কি ভাবে যাবে ? রাস্তাঘাট চিনবে কি করে? তারা তো কেবল জানে চাঁদপুর জাহাজ ঘাট।
সেখানে যেতে পারলেই জাহাজে চড়ে বাড়ি ফিরা যাবে। জাহাজ ঘাট যাবে কি করে? সবাই জড়ো হতে থাকে রেলস্টেশনে। তখন চা-বাগান মালিক ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শ্রমিকদের রেলের টিকেট না দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
উপায় খুব সহজে বেরিয়ে যায়। হাঁটা। এই রেল লাইল ধরেই হাঁট। সবাই সেই রেল লাইল ধরেই হাঁটতে থাকে চাঁদপুর জাহাজ ঘাটের উদ্দেশ্যে। তাই এই আন্দোলন “মুল্লকে চলো“ আন্দোলন হিসেবে বেশি পরিচিত।
ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হাজার হাজার শ্রমিকরা এসে জড়ো হয় জাহাজ ঘাটে। জনপ্রিয় নেতা হরদয়াল নাগের নেতৃত্বে এদের জন্য চিড়া ও চাউল ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শ্রমিকদের রান্না করার মনোবল এবং শক্তি কোনটাই ছিলনা। তারা কাঁচা চাউল চিবিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন।
যখনই স্টিমার ঘাটে এসে ভীড়ে অমনি প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠে। সবাই ধাক্কা ধাক্কি করে স্টিমারে উঠতে ব্যস্ত হয়ে যায়। জাহাজ কর্মচারীরা চায় টিকেট। টিকেট কাটতে লাগে টাকা চা-শ্রমিকদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কোথায় পাবে টাকা? কোথায় টিকেট? অনেক অনুনয় বিনয় করেও জাহাজ কর্মীদের মন টলানো যায়না।
এক পর্যায়ে জাহাজ তাদের সাথে ধাক্কা ধাক্কি শুরু হয়। সিঁড়ি দিয়ে একসাথে উঠতে গিয়ে ঝপাঝপ পড়ে পানিতে।
পরিস্থিতির উপর সরকারেরও তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছিল।তাই প্রস্তুত রেখেছিল পুলিশ বাহিনী। হুইসেল বাজতেই একদল সশস্ত্র পুলিশ এগিয়ে আসে। জাহাজের সিঁড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়তে থাকে।
জাহাজের সিঁড়ি থেকে শ্রমিকদের রক্তাক্ত দেহ পরতে থাকে পানিতে।শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অল্প সময়েই জাহাজ ঘাট শুন্য হয়ে যায়।
এই আক্রমনে কত জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল? কত জন আহত হয়েছিল। তার কোন হিসাব নেই। লোকজন শুধু নদীতে লাশের সারি ভেসে যেতে দেখেছে।
সবচেয়ে পাশবিক ঘটনাটি ঘটেছে চাঁদপুর রেলস্টেশনে। রেলইয়ার্ডে ৩,০০০–৪,০০০ শ্রমিক জড়ো হয়েছিল। ২০ মে তাদেরও জাহাজ ঘাটে পৌঁছনোর কথা।
রাতের অন্ধকারে গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা রেলওয়ে ইয়ার্ড ঘিরে ফেলে। সরকার পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ এলাকায় কোন লোকজনকে যেতে নিষেধ করা হয়। সরলপ্রাণ ক্লান্ত শ্রমিকরা রহস্যটা বুঝতে পারেনি। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে অচেতন। কমিশনার কে.সি দে-এর নির্দেশে গুর্খা সৈন্যরা ঘুমন্ত শ্রমিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে।
শ্রমিকদের আর্তচিৎকারে আকাশ বতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ গুম করে ফেলে গুর্খা বাহিনী।
এখানেও কতজন নিহত ,কত জন আহত হয়েছে তারও কোন হিসেব করা হয়নি। বাগান মালিকরা ভেবেছিল ত্রাসের সঞ্চার করে তাদের আবার বাগানে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই একটি অতিরিক্ত কামরাসহ রেলগাড়ী স্টেশনে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।
কিন্তু উদ্দেশ্য খুব একটা সফল হয়নি। আক্রমনের ফলে সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিকরা। মাড়োয়ারী পাট ব্যবসায়ীরা তাদের পাটের গুদামে এবং মানুষজন তাদের বাড়ি ঘরে আশ্রয় দেয়।
চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের উপর হামলার প্রতিবাদে ডাকা হলো হরতাল। রেল ও জাহাজ কোম্পানির কর্মীরা এই হরতালে সমর্থন জানায় এবং প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ গ্রহন করে।
ধর্মঘট পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রেল কর্মচারীদের এই ধর্মঘট আড়াই মাস স্থায়ী হয় এবং ৪,৫০০ কর্মী চাকরিচ্যুত হয়। জাহাজ কর্মীদের ধর্মঘট চলে ছয় সপ্তাহ।
এদিকে চা-শ্রমিকদের খাদ্য যোগানোর জন্য হারাধন নাগের নেতৃত্বে রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়। জনসাধারণ উদার ভাবে সাহায্যে হাত বাড়ান। এক পর্যায়ে সরকার শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ করতে চাইলে শ্রমিকরা তা নিতে অস্বীকার করে।
কিছুদিন পরেই শ্রমিকদের মধ্যে কলেরা মহামারী আকারে দেখা দেয়। বহু শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। এই মহামারী নিয়ন্ত্রন আনতে স্বেচ্ছাসেবকরা প্রাণান্ত পরিশ্রম করে।
রেলস্টেশন থেকে পন্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিতসহ নেতৃস্থানীয় শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। জেলখানা কতৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে পন্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিত অনশন করে প্রাণ বিসর্জন দেন। তারপর কি হয়??? তারপর রাজনীতি।
১) এ মর্মান্তিক ঘটনার পরও যেসব শ্রমিক নিজ মুল্লুকে যতে একান্ত ইচ্ছুক, কোম্পানি তাদের যাবার ব্যবস্থা করবে।
২) কিছু কংগ্রেস কর্মী গিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।
৩) বাকীরা আসামে ফিরে গিয়ে আবার কাজ পাবে।
৪) কোম্পানি তাদের কাজ পেতে কোন অসুবিধার সৃষ্টি করবে না।
ছেলে ভোলানো চার দফার আপোষের মাধ্যমে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে।
উপরের ঘটনা্টি হলো ব্রিটিশ আমলের কিন্তু আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে চা-শ্রমিকরা কেমন আছে তা নিচের আলোচনা থেকে বুঝা যাবেঃ
বাংলাদেশের ২৪১টি (ফাঁড়িসহ) চা বাগানে প্রায় ১৫ লক্ষ চা জনগোষ্ঠী ১৮০ বছর ধরে বসবাস করছে (বিটিবি,২০১৫) । যদিও এই চা শ্রমিকরা বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু পর্যাপ্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না।
চা শিল্পের মাধ্যমে এই চা শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অথচ তাদের জীবনমান উন্নয়নে কোন ধরণের সরকারি উদ্যোগ পরিলিক্ষিত হচ্ছে না।
শিক্ষা,স্বাস্থ্য,চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা যেমন বঞ্চিত তো হচ্ছেই অপরদিকে নিজ জমির কোন দলিল-দস্তাবেজ না থাকায় তাদের বসত-ভিটা-কৃষি জমিও প্রতিনিয়ত দখল হচ্ছে। এই গবেষণার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকারসহ তাদের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
চা বাগানের অন্যতম প্রধান সমস্যা হল দারিদ্র্য। যেহেতু অতি দারিদ্র্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,যে ব্যক্তির দৈনিক আয় ১.২৫ ডলারের কম এবং দৈনিক ১৮০০ কিলোক্যালরির কম খাদ্য গ্রহণ করে তাকে অতি-দারিদ্র্য বলে সেহেতু চা শ্রমিকরা অতি দারিদ্র্যের পর্যায়ভূক্ত।
কেননা,তাদের দৈনিক আয় ১.২৫ ডলারের কম (৮৫ টাকা)এবং তারা ১৮০০ কিলোক্যালরির কম খাদ্য গ্রহণ করে। অথচ চা-শ্রমিকের অতি-দারিদ্রতার বিষয়টি তো দূরের কথা দারিদ্র্যের বিষয়টিও পিআরএসপি,সপ্তম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনা ইত্যাদিতে উল্লেখ করা হয় নি। যার ফলে দেশের চা-শ্রমিকদের সমন্বিত উন্নয়ন ব্যবস্থা ছিটকে পড়ছে।
চা বাগান অঞ্চলে শিক্ষার হার খুবই কম। যে শিশুদের স্কুলে যাবার কথা তারা কাজ করে চা বাগানে। ২৪১ টি চা বাগানের মধ্যে কোন চা বাগানে কলেজ নেই, হাই স্কুল রয়েছে মাত্র দুইটি, আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে হাতেগোনা কয়েকটি।
একদিকে যেমন ৫-৬ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে যেতে হয় অন্যদিকে শারীরিক অবয়ব ও ভাষাগত সমস্যার কারণে তারা মূল ধারার ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা বিভিন্ন ধরণের লাঞ্ছনার শিকার হয়।
যে কারণে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হবার আগেই অনেক শিশুই ঝরে পরে। দেশের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য চাকুরী ও শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন কোটা সুবিধা রয়েছে, চা-জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কোন বিশেষ কোটা ব্যবস্থা নেই।
অথচ চা-জনগোষ্ঠী দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। দেশের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য চাকুরী ও শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন কোটা সুবিধা রয়েছে, চা-জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কোন বিশেষ কোটা ব্যবস্থা নেই।
বাংলাদেশের চা বোর্ডের হিসাবমতে স্থায়ী চা শ্রমিকের সংখ্যা ১,১৯,০০০ জন অথচ মাত্র ৯৩৫০০ চা শ্রমিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধা পাচ্ছে (সুত্রঃপ্রভিডেন্ট ফান্ড অফিসের সিটিজেন চার্টার)। শ্রম আইন অনুযায়ী যেখানে ৩ মাস কাজ করার পর একজন চা শ্রমিক স্থায়ী শ্রমিক হবার অধিকার রাখে সেখানে ২০-২৫ বছর কাজ করার পরেও প্রায় ২৫০০০০ চা শ্রমিককে অস্থায়ী রাখা হচ্ছে না যারা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধা থেকে।
চা-বাগানগুলোতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের অবস্থা খুবই নাজুক কারণ এখানে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলে রসিকতা। অধিকাংশ চা-বাগানগুলোতে হাসপাতাল নেই আবার হাসপাতাল থাকলে ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই,প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নেই।
এই নেই নেই এর মধ্যে চলছে বাগানগুলোর স্বাস্থ্যসেবা। অভিজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী না থাকায় চা-বাগানগুলোতে মাতৃ হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। ১৯৬২ সালের টি প্লান্টেশন লেবার অডিন্যান্স এবং ১৯৭৭ সালের প্লান্টেশন রুলস-এ চা বাগানগুলোতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা মালিকের দায়িত্ব থাকলেও তা করা হচ্ছে না।
যক্ষ্মা, টাইফয়েড, ,রক্তশুন্যতা,ডাইরিয়া ইত্যাদি চা-শ্রমিকদের নিত্য দিনের সঙ্গী।
বর্তমানে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী মাত্র ৮৫ টাকা।সম্প্রতি দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। সেই সাথে বেসরকারি খাতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
যার ফলে স্বাভাবিকভাবে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের চা-শ্রমিকদের মজুরী ৬৫০-১০০০ টাকা বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা পাচ্ছে মাত্র ৮৫ টাকা। স্বল্প মজুরীপ্রাপ্ত এই চা শ্রমিকরা বাজারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে তাল মেলাতে পারছে না বলে তাদের দৈনন্দিন জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।
চা-শ্রমিকরা প্রজন্মনের পর প্রজন্ম চা-বাগানে বসবাস করলেও তারা তাদের বসতভিটার মালিকানা পায়নি। তারা যেন নিজ ভূমে পরবাসী। চা-বাগানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি আবাসন ও পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাগান মালিকের থাকলেও এটি নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই।
চা-শ্রমিকরা ৮/১২ ফুট মাপের একটি ঘরে অন্তত তিনটি প্রজন্ম বাস করে; যা পুরো মানব সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক। একটি ঘরে তিন প্রজন্ম বাস করা যেমন অস্বাস্থ্যকর তেমনি মানহানিকর ওই ঘরের সবার জন্য, সমাজের জন্য তো বটেই। এতে করে বাগানের শিশুদের আত্মসম্মান ও মানসিক বিকাশ হচ্ছে না।
দেশের বেশির ভাগ চা বাগান পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় সেখানে কূপ খনন বা নলকূপ স্থাপন তুলনামুলকভাবে ব্যয় বহুল। যার কারণে চা শ্রমিকরা গাং বা ঝর্নার পানি পান করে।
চা শ্রমিকরা যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের বাসিন্দা।বেশিরভাগ বিদ্যুৎ-সংযোগ না থাকায় চা শ্রমিকরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে তেমন ধারণা পায় না (টেলিভিশন দেখতে পারে না)। অপরদিকে চা শ্রমিক সন্তানরা কুপী বাতির সাহায্যে পড়াশোনা করে যা তাদের চোখের জন্য ক্ষতিকর।
শিশু শ্রমঃ বাংলাদেশের প্রতিটি চা বাগা্নেই শিশু শ্রমিক নিয়োজিত আছে যেখানে বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী {অধ্যায় ৩, ধারা-৩৪(১)} শিশুশ্রম নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী (অধ্যায় ২, ধারা-৫) চা বাগান কর্তৃপক্ষ কাজে নিয়োগদানের পূর্বে একজন চা শ্রমিককে নিয়োগপত্র দিতে বাধ্য।প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কোন চা শ্রমিককে নিয়োগপত্র দেয়া হয় না।
আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে ভারতের বিহার, মাদ্রাজ,উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কানু,তেলেগু, লোহার, রবিদাস, গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ এ অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়।
যাদের প্রত্যেকের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ধর্মীয় রীতিনীতি, পূজা-উৎসব, বিবাহপ্রথা,সমাজ কাঠামো দেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
নৃ-তাত্ত্বিক সংজ্ঞানুসারে চা জনগোষ্ঠীর কেউ প্রাক-দ্রাবিড়ীয়,কেউ আদি অষ্ট্রালয়েড, কেউবা মঙ্গোলীয় আদিবাসীর অন্তর্ভুক্ত।কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত তো দে-ই নি, এমনকি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর তালিকায়ও এদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেনি,যে কারণে এরা কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
বরঞ্চ এদেরকে অন্তর্ভুক্ত করলে এরা দেশের সরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও চাকুরী ক্ষেত্রে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারতো এবং নিজেদের দুরাবস্তার পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারতো।
চা চাষের জন্য সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট মেয়াদে ১,১১,৬৬৩.৮৩ হেক্টর জমি লীজ মঞ্জুর করা হয় যার ৫১.১১ % জমিতে চা চাষ করা হয়। একর প্রতি বাৎসরিক লীজের পরিমাণ ৫০০ টাকা।
অপরদিকে প্রতি একর কৃষি জমি ব্যবহারের জন্য চা শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৩ কেজি রেশন কর্তন করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রসাশক এই লীজ দেখভাল করেন।
চা-শ্রমিকরা দীর্ঘ ১৮০ বছর ধরে চা বাগানে বসবাস করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা ভূমির অধিকার পায় নি – তারা যেন “নিজভূমে পরবাসী”। চা শ্রমিকদের ভূমির কোন দলিল-দস্তাবেজ না থাকার কারণে তাদেরকে নিম্নরূপ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়ঃ
বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ জরুরী হওয়া সত্ত্বেও ভূমির দলিল-দস্তাবেজ না থাকার কারণে চা শ্রমিকদের কোন প্রকার ঋণ দেয়া হয় না। যার ফলে চা শ্রমিকদের পক্ষে বৃহত্তর ব্যবসা উদ্যোগ গ্রহণ,কৃষি কাজে বিনিয়োগ ইত্যাদি।
চা বাগান মালিক কর্তৃক নির্ধারিত ঘর (৮ ফুট/১২ ফুট) ব্যথিত ঘর নির্মাণ করতে চাইলে বেশির ক্ষেত্রেই অনুমতি দেয়া হয় না। ভূমির অধিকার না থাকার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে।
ভূমি অধিকার না থাকার কারণে চা শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত জমি দখলের শিকার হচ্ছে। সরকার,চা-বাগানের মালিক, প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে সাধারণত চা শ্রমিকরা জমি দখলের শিকার হয়।
চান্দপুর-বেগমখান চা বাগানের ১২৫০ টি চা শ্রমিকরা পরিবারের ৫১১.৮৩ একর কৃষি-জমি দখল করে সরকার “বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। এই জমি দখল করার পূর্বে সরকার চা শ্রমিক পরিবারগুলোকে কোন প্রকার পুনর্বাসন, ক্ষতি-পূরণ দেয়া তো দূরের কথা তাদের সাথে কোন আলোচনায় করে নি।
তার কারণ একটাই চা শ্রমিকদের ওই জমির কোন কাগজ-পত্র নেই। লাখাই চা বাগানের ৭০ টি চা শ্রমিক পরিবারের প্রায় ১০০ একর কৃষি জমি দখল করে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চা গাছ লাগানো হয়েছে।
লাক্কাতুরা চা বাগানের চা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ না দিয়েই তাদের জমিতে প্রভাবশালী মহল কর্তৃক নির্মিত হয়েছে “সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। জমি দখলের এ রকম চিত্র প্রায় প্রতিটি চা বাগানেই দেখা যায়।
কোন চা শ্রমিক পরিবার চা বাগানে কাজ না করলে তাকে চা বাগান থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়।নিজভূমে পরবাসী এই চা শ্রমিকরা চার প্রজন্ম ধরে বসবাস করেও চা বাগান থেকে তথাকথিত “কালো আইন” নামে উচ্ছেদ হচ্ছে।
চা শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি (কমপক্ষে ২৫০ টাকা), বিদ্যমান ভুমিসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান এবং চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন অতীব প্রয়োজন।
চা-শ্রমিকদের নিম্নলিখিত দাবী আদায়ের লক্ষ্যে প্র্তিনিয়ত বিভিন্ন চা বাগানে আন্দোলন সংগ্রাম চলছেঃ
১।চা বাগানে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তালিকায় অন্তভূক্ত করা ;
২।দেশের সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষঠা্ন ও সরকারি চাকুরীতে কোটা সংরক্ষণ করা ;
৩।চা জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা ;
৪।চা জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য একটি কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা ।
৫।চা বাগানে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, কারিগরি বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা করা ;
৬।জাতীয় বাজেটে চা জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ দেয়া ;
৭।চা বাগানের বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে একটি কমিশন বা মন্ত্রণালয় গঠন করা;
৮। চা বাগান এলাকায় পর্যাপ্ত সরকারী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা ।
৯। চা বাগানের ছাত্র-ছাত্রীদের কারিগরি প্রশিক্ষণসহ বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করা ।

মোহন রবিদাস বিএসএস (সম্মান),এমএসএস(লোক-প্রশাসন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একজন চা-শ্রমিক সন্তান। বর্তমানে কমিউনিটি জাস্টিস ফেলো হিসেবে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাষ্ট (ব্লাস্ট) এ কাজ করছেন।

Leave a Reply