সম্পাদকের নোট: লেখাটি সাপ্তাহিক চিত্রালীতে ১৯৭৩ সালের ৯ই নভেম্বর প্রকাশিত হয়। সাঈদা খানম (১৯৩৭-২০২০) ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী পেশাদার আলোকচিত্রী।
সত্যজিৎ রায়ের কাছে খোলা চিঠি
সাঈদা খানম
শ্রদ্ধেয় মানিকদা,
আপনার অশনি সংকেতের সমালোচনা আপনি অহরহ শুনতে পাচ্ছেন ফোনে। পড়ছেন পত্রপত্রিকায়, চিঠিতে। দর্শক হিসেবে প্রত্যেক দর্শকেরই নিজস্ব একটা স্বাধীন মতামত আছে। আপনি সেই মতামত জানতে ও শুনতে ভালোবাসেন এবং তা নিয়ে ভাবেনও।
অশনি সংকেত আমার পক্ষে দেখা সম্ভব হত না যদি না আপনি দেখার সুযোগ করে না দিতেন। হলে যেয়ে দুদিন ফিরে এসেছিলাম টিকিট না পেয়ে। অথচ ওখানে থাকতে কৃতজ্ঞতাটুকু প্রকাশ করার সুযোগ পেলাম না। মতামত জানাবার একটা তীব্র ইচ্ছাও ছিল । যে সময়টুকু ছিলাম এ অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ফোন হয়ে গেল প্রানহীন, নিশ্চুপ।
যেদিন চলে আসি। আকাশ ছিল ঘোলাটে, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। বিষণ্ন, ম্লান সকাল। রানওয়ের উপর দিয়ে প্লেনটা যখন ছুটছিল অশনি সংকেতের ঘোলাটে আকাশ ছুয়ে গেল মনকে। যে ঘোলাটে আকাশের ছোয়া এখনও আমাদের জীবনের উপর ছায়া ফেলে আছে।
জীবনে রং ছিল। কি সুন্দর রং ছিল গ্রাম্য জীবনের। দুর্ভিক্ষের ছায়ায় যে রং ক্ষয়িষ্ণু হল, প্রকৃতির রং বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাকে আপনি যে ভাবে ধরে দেখিয়েছেন — তা ভোলা যায় না। কখনও কখনও শিল্পী গগার পেইন্টিংকেই যেন দেখতে পেয়েছি বিচিত্র রং এর সমারোহে , দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির দৃশ্যে।
একটু পরেই আমার ভাবনাই ছেদ পড়লো। মোড় ঘুরে গেল। রানওয়ের পাশে কাশ ফুলের উপর দৃষ্টি পড়তেই। চোখের সামনে অপু ছুটে এল। কাশবন আর ঘোলাটে আকাশ পথের পাঁচালী আর অশনি সংকেত দুটো ছবিই আপনার সৌন্দর্যের আধার। তবে গতি, রং আর সৌরভ আলাদা। তবু কোথায় যেন একটা সমন্বয় আছে। সত্য আর সুন্দরের উদয় – যা দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র , অনাহার কেউ ধ্বংস করতে পারে নি। যার মধ্যে আছে চিরন্তন মানবিক আবেদন।
আপনার ‘পথের পাঁচালী’ যখন প্রথম দেখি তখন বিশ্বের চোখে ধরা পড়েনি আপনার ছবির সৌন্দর্য। কোন পুরস্কারে চিহ্নিত নয়। মুক্তি পেয়েছে অল্প কয়েকদিন হলো। হলে দর্শক অতি সামান্য। এ বই ভালো লাগার মত মানসিকতা তখনকার দর্শকদের না থাকারই কথা। আমার নিজের কতখানি ছিল জানিনা। কিন্তু ছবি দেখতে দেখতে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। রাত্রিতে ঘুম হল না। সমস্ত মন জুড়ে বিচিত্র অনুভূতি। সেদিন থেকেই আমি আপনার ভক্ত।
আপনাকে চাক্ষুস যেদিন দেখি, সেদিনটা আমার ভয়ে, আনন্দে, গর্বে, স্মরণীয় হয়ে আছে। চিত্রালীর পক্ষ থেকেই আমি আপনার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে এর ওর কাছে আপনার সম্পর্কে যা জানলাম তাতে মনটা দমে গেল। শুনলাম আপনি ভীষণ রাশভারি। কেউ প্রশ্ন করলে হ্যাঁ না ছাড়া জবাব দেন না।
আপনি তখন সবে কাঞ্চনজংঘার সূটিং শেষ করে দার্জ্জিলিং থেকে কলকাতায় ফিরেছেন। বেশ একটু ভীরুতা সঙ্গে বিষণ্ন মন নিয়ে দেখা করতে গেলাম আমার কেমন যেন ধারণা হয়ে গিয়েছিল আমার মত অতি সাধারণ মেয়ে রিপোর্টার হিসেবে দেখে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন। কিন্তু আপনি যখন বিনীতভাবে বললেন আমার ছবি সম্পর্কে আপনি কি জানতে চান , বলুন তখনই বুঝলাম কাউকে আপনি অশ্রদ্ধার চোখে দেখেন না।
কাউকে না। পরবর্তী কালে এটা আরও স্বচ্ছভাবে দেখলাম। আপনার সঙ্গে স্টুডিওতে যাচ্ছিলাম। স্টুডিওর গেটের সামনে দারোয়ান উঠে দাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আপনি তাকে করযুক্তভাবে নমস্কার করেন। এদের হাতে রাখী বেঁধে দেবার গল্পও করলেন। ঘটনা অতি তুচ্ছ কিন্তু তখনই বুঝলাম সাধারণ মানুষকে সম্মান করার মধ্যেই আপনার সৃষ্টির উপাদান। আরও অবাক আরও বিস্মিত হয়েছিলাম একাত্তুরের ভয়ঙ্কর ন’টা মাস মঙ্কুদি ও আপনি অনেকের কাছে আমার খোঁজ করেছিলেন জেনে। মানবতার এই অনুভবের স্পর্শটুকু এই স্বার্থের যুগে সমাজে মেলে না।
মৃত্যু কি? না মরলে জানা যায় না। কিন্তু চারপাশে তার আলিঙ্গণ নিয়ে প্রতীক্ষা করা যে কত কঠিন আপনাকে তা বুঝাতে পারবো না। তবু তার মাঝে কি ভাবতাম জানেন? যদি বেঁচে থাকি যদি আপনার সঙ্গে দেখা হয় তাহলে এই পটভূমিতে আপনাকে একটা ছবি করতে বলবো। কেন জানিনা ‘টু উইমেন’ ছবিটার কথা মনে পড়তো। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে যে স্বাভাবিক ভাঙ্গন আসে তার শিকার হয় মেয়েরা। আপনি বলেছিলেন অশনি সংকেতে যুদ্ধ নেই কিন্তু তার ইঙ্গিত আছে।
মনের মধ্যে যা খুঁজছিলাম তাই যেন দেখতে পেলাম অশনি সংকেতে। এখানে একটা কথা বলে নেই – আপনার ওখানকার দর্শকরা যে দৃষ্টিতে বইটি দেখেছে আমি কিন্তু তা পারিনি। কারণ আমার অনুভূতির মধ্যে এখন আছে একাত্তরের কান্না। ওদের কাছে একদা যা ঘটেছিল আমার কাছে তা অতি নিকট অতি বাস্তব।
অনঙ্গের ‘বৌ’ এর ভূমিকায় ববিতার অভিনয় সম্পর্কে কোলকাতার পত্রপত্রিকায় দেখলাম দুই রকমের মতামত রয়েছে। কোন পত্রিকা প্রশংসা করেছেন কোন পত্রিকা লিখেছে – ববিতার মধ্যে গ্রাম্য মেয়ের চরিত্র ফোটেনি। কথাটা সত্যি। আমার নিজেরও তাই মনে হয়েছে। আধুনিক মেয়ের ছাপ এসে গেছে অনঙ্গের বৌ পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কথা বলেছে। আপনি অবশ্য এ সম্পর্কে যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা অস্বীকার করা যায় না। গ্রামের গরীব ব্রাহ্মণের ছেলে অনেক সময় শহরের মেয়েকে বিয়ে করে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ববিতা তার চরিত্রে মানিয়ে গেছে, কিন্তু অভিনয়ের দিক থেকে ববিতার কাছ থেকে আরও কিছু আশা করেছিলাম। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় বার্লিনেই প্রশংসা পেয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার লেগেছে অপূর্ব। আপনার ছবির আরেকটা পুরুষ চরিত্র কিন্তু মনে দাগ কেটে ফেলে। যে যুবকটার সঙ্গে ছুটকী পালিয়ে গেল । যার মুখ বাজীর আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। ছুটকীকে (সন্ধ্যা রায়) ভালো লাগে তার সাবলীল অভিনয়ের জন্য। চরিত্রটি বিচার করলে ঘৃনার। কিন্তু তার প্রতি ঘৃণা জাগে না – জাগে ব্যাথা ও করুণা।
আপনার ছবির প্রতিটা শটের দৃশ্যই অপূর্ব। মনে হয় প্রতীক হিসেবে আপনি অনেক রং ব্যবহার করেছেন। ঘন সবুজ বনের ভেতর দিয়ে ছুটকী যখন এগিয়ে চলেছে দেহের বিনিময়ে চাল সংগ্রহ করতে । তার পরণের শাড়ীর গাঢ় লাল রংটা না-বলা অনেক কথা দেয়। যেমন বলে দেয় অনঙ্গের বউ ধর্ষিত হওয়ার পূর্বে আঁধারের মাঝে জলে সিগারেটের আগুনটুকু।
আপনার অশনি সংকেতের সমালোচনা একবার দেখে বোধ হয় করা যায় না। শুধু ভালো লাগাটুকু প্রকাশ করা যায়।
রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ যে কারণে করা বন্ধ করে দিলেন তা আমার খুব মজা লেগেছে। আপনি আবার নতুন গল্প খুঁজছেন। বাংলাদেশে এসে যে গল্পটার রুপ দেবার কথা ভাবছিলেন সেটা এসে করুন না। যে কাহিনী ইস্টিমারকে কেন্দ্র করে।
আপনি বলেছেন ভালো গল্প না পেলে কিংবা বাংলাদেশে যেয়ে ছবি করা সম্ভব না হলে এবার আপনি ছোটোদের জন্য ছবি করবেন। আপনার কাছে ওদের একটা দাবী আছে। দাবী আমাদেরও আছে, সে কথাটা ভুলে যাবেন না।
ইতি
সাঈদা খানম