উনিশ শতকে বাংলার রাজনীতিতে উলামা

ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ রচিত ‘রাজনীতিতে বংগীয় উলামার ভূমিকা ( ১৯০৫-১৯৪৭) একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ইসলামি ফাউণ্ডেশন থেকে ১৯৯৫ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটি সহজলভ্য না হওয়ায় পাঠকদের জন্য আমরা উল্লেখযোগ্য অংশগুলো তুলে ধরছি। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নোট ও ছবি সংযোজন করে বিষয়বস্তুকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি — সামসুদ্দোজা সাজেন, বাংলাদেশ অন রেকর্ড সম্পাদক

 অধ্যায় ১: উনিশ শতকে বাংলার রাজনীতিতে উলামা

ফারায়েজি আন্দোলন ছিল বাংলা তথা উপমহাদেশের সর্বপ্রথম সংগঠিত আন্দোলন। ফরিদপুর ছিল এর উৎসস্থল। ধীরে ধীরে তা ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও খুলনা জেলায় বিস্তৃতি লাভ করে। বাহ্যত এটি ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারমূলক তথা কৃষক-প্রজা আন্দোলন হলেও এর অন্তর্নিহিত রূপ ছিল রাজনৈতিক। এই আন্দোলনের উদ্যোক্তা ময়লানা হাज़ী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১–১৮৪০ খ্রি.) এই উপমহাদেশকে ‘দারুল-হারব’ (যুদ্ধভূমি) বলে মনে করতেন। “এখানে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা নাই”— এই ধর্মীয় যুক্তিতে তিনি এবং তাঁর উত্তরসূরি নেতৃত্বও বাংলা ফারায়েজি-প্রধান অঞ্চলসমূহের মুসলমানদেরকে জুমুআ ও ঈদের নামাজ থেকে বিরত রেখেছিলেন। এ দেশকে ‘দারুল-হারব’ ঘোষণা করা এবং জুমুআ ও ঈদের নামাযের প্রচলন বন্ধ করার পেছনে এটা বোঝানোই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল যে, এ দেশ পরাধীন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে এ দেশকে আবার মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। দেশ যুক্তি-শাসনমুক্ত হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ফারায়েজিরা জুমুআ ও ঈদের নামায থেকে বিরত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তারা জুমুআ ও ঈদের পুনঃপ্রচলন করেন। তবে এখনও কোনো কোনো ফারায়েজি নেতা গ্রামে জুমুআ ও ঈদের নামায পড়া উচিত নয় বলে মনে করেন।

ফারায়েজি আন্দোলনকে ‘উলামা-আন্দোলন’ বলে অভিহিত করা যায়। কেননা হাज़ী শরীয়তুল্লাহ কর্তৃক এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হস্তান্তর হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩০ বছর যাবৎ যাঁরা এ আন্দোলনের শিরোমণি ও সহকারী ছিলেন, তাঁদের সবাই বিভিন্ন মানের আলিম ছিলেন। শরীয়তুল্লাহ একটানা ২০ বছর (১৭৮৮–১৮০৮ খ্রি.) মক্কা শরীফে ধর্মীয় উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। মক্কা শরীফে থাকাকালে তিনি সেখানকার ওহাবী মতবাদের প্রভাবিত হন। আমৃত্যু দীর্ঘ ২২ বছর (১৮১৮–১৮৪০ খ্রি.) তিনি ফারায়েজি আন্দোলন নেতৃত্ব দেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহসিনুদ্দীন (দুদু মিঞা) এ আন্দোলনের হাল ধরেন এবং ২২ বছর (১৮৪০–১৮৬২ খ্রি.) এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়ে ফারায়েজি আন্দোলন চরমে উঠে। বৃটিশ মদদপুষ্ট জমিদার ও ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। সত্যিকার অর্থে তা কৃষক–প্রজা আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।

আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগেই দুদু মিঞা ঘোষণা করেন যে, “ভূমির মালিক আল্লাহ্‌; তাই সরকার ছাড়া জমিদার বা তালুকদারের খাজনা আদায়ের অধিকার নাই।” তিনি তাঁর অনুসারীদের এলাকা ভিত্তিক কোর্টে পাশাপাশি নিজস্ব কোর্ট স্থাপন করেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী আন্দোলনের সময় বৃটিশ বিরোধী মনোভাবের জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৮৫৮ সালে মুক্তিলাভ করেন। পিতার ন্যায় বড় আলিম না হলেও তিনি মামুলি ধরণের শিক্ষিত ছিলেন না। পাঁচ বছর মক্কা শরীফে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি দেশে ফিরে পিতার নিকট অধিকতর ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করেন। সৌভাগ্যবশত তিনি মওলানা আবদুল জব্বার (মৃ. ১৯০১ খ্রি.) এর ন্যায় একজন বড় আলিম ও তর্কবাগীশকে তাঁর খলীফারূপে পেয়েছিলেন।

দুদু মিঞার মৃত্যুর (১৮৬২ খ্রি.) পর তাঁর বড় পুত্র সিয়ামুদ্দীন হায়দার ফারায়েজিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৬৩ খ্রি. তাঁর মৃত্যু ঘটলে দুদু মিঞার দ্বিতীয় পুত্র আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিঞা এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৮৮৪ খ্রি. পর্যন্ত এ নেতৃত্ব অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর সময়ে ফারায়েজি আন্দোলনের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। তবে ১৮৭৩ খ্রি. মাদারীপুরে ফারায়েজিপন্থী কৃষকদের সাথে হিন্দু জমিদারদের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।

ফারায়েজি নেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতা করার প্রচেষ্টা পান। পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর নয়া মিঞা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিজ বাড়ীতে এক পেশোয়ারী পাঠান মোল্লার কাছে দীর্ঘ দিন ধরে ধর্মীয় জ্ঞান-চর্চা করেন।

নয়া মিঞার মৃত্যুর (১৮৮৪ খ্রিঃ) পর দুদু মিঞার তৃতীয় পুত্র খান বাহাদুর সাঈদুদ্দীন আহমদ ফারায়েজিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯০৬ খ্রিঃ পর্যন্ত ২২ বছর নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনিও বিশিষ্ট আলিম ছিলেন। তিনি ঢাকা মাদ্রাসায় বেশ কিছুকাল অধ্যয়ন করেন। ঢাকা মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট প্রখ্যাত মওলানা উবায়দুল্লাহ উবায়েদী (১৮৩৪–১৮৮৪ খ্রি.) ছিলেন তাঁর অন্যতম শিক্ষক। সাঈদুদ্দীনের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম যথাস্থানে বর্ণিত হবে।

১৯০৬ সালে সাঈদুদ্দীন আহমদের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র মওলানা রশীদুদ্দীন (বাদশা মিঞা) ফারায়েজি আন্দোলনের ১৪তম গদিনশীন নিয়ুক্ত হন। তিনি আমৃত্যু (১৯৫৩ খ্রি.) ফারায়েজিদের নেতৃত্ব দেন। পূর্বসূরি নেতাদের ন্যায় তিনিও বিশিষ্ট আলিম ছিলেন। তিনি ঢাকা মুসলিম মাদ্রাসায় ‘জামাআত-এ-হাশতুম (তদানীন্তন ৩য় শ্রেণি) থেকে ‘জামাআত-এ-উলা’ (বর্তমান ফাযিল) পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন (১৮৯৮–১৯০৫ খ্রি.)। কিন্তু পিতার মৃত্যুর (১৯০৬ খ্রি.) পর তিনি ফাইনাল মাদ্রাসা পরীক্ষা দিতে পারেন নি। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যথাস্থানে বিবৃত হবে। ফারায়েজি আন্দোলনে যারা তাঁর সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মওলানা আবদুল জব্বার, মাওলানা সানাউল্লাহ, মওলবি কফিল আহমদ ও মাওলবি আবদুল হাই প্রভৃতির নাম উল্লেখ্য। এদের সবাই বিশিষ্ট ধর্মবেত্তা ছিলেন।

১৮২৬ সালে সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলবী (১৭৮৬–১৮৩১ খ্রি.) পাঞ্জাবের শিখযুদ্ধে রওনা হলে তাঁর খলিফা মওলানা কারামত আলী জৌনপুরী তাঁর নিকট ঐ জিহাদে যোগদানের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু সৈয়দ সাহেব তাকে বঙ্গে জিহাদের বাণী প্রচারের নির্দেশ দেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত (রংপুর ১৮৭৩ খ্রি.) পর্যন্ত তিনি মুর্শিদের এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। ১৮২২ সালের অক্টোবরে সৈয়দ আহমদ শহীদ হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফের পথ কলকাতায় পদার্পণ করেন। তখন মাওলানা কারামত আলীও  তাঁর সাথে প্রথমবারের মত বংগে আগমন করেন। তদবধি তিনি তিন–চার দফা জৌনপুর–বাংলায়  যাতায়াত করেন এবং ৫১ বছরেরও বেশি সময় ধরে (১৮২২–১৮৭৩ খ্রি.) এই দেশের জিহাদের বাণী প্রচার, ইসলামী শরীয়তের শিক্ষাদান, ইসলামী আচার–অনুষ্ঠান ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় ব্যপৃত থাকেন।

মওলানা শাহ আবদুল আযীয (১৭৪৬–১৮২৪ খ্রি.) ১৮০৩ সালে ভারতকে ‘দারুল হারব’ বলে ফতোয়া দেন। তাঁর প্রতিনিধির সৈয়দ আহমদ শহীদ অনুরূপ ঘোষণা দেন ১৮১৮ সালে। পরবর্তী সময়ে কলকাতা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মওলানা মুহম্মদ ওজীদ (মৃ. ১৮৬৪ খ্রি.), কলকাতার প্রধান কাজী ফযলুর রহমান, সৈয়দ আহমদ শহীদের পাটনাস্থ খলীফা মওলানা বিলায়াত আলী (মৃ. ১৮৫২ খ্রি.), ফারায়েজি নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহ ও হাজী দুদু মিঞা প্রমুখ সেই ধারা জিইয়ে রাখার প্রয়াস পান। মওলানা কারামত আলী জৌনপুরী ছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদের বংগীয় খলিফা। তাই স্বভাবতই বলা যায়, “বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করার সময় সম্ভবত তিনি ঘোরতর বৃটিশ বিরোধী ছিলেন।”

বর্তমান বাংলাদেশের সিলেটে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) বৃটিশদের পক্ষে অংশগ্রহণকারি সমকালীন লেখক জি. এন. ডড ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাবাসীর বৃটিশ বিরোধী মনোভাব ব্যাখ্যা করে বলেন, “কেরামত আলী নামক একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি কুখ্যাত সম্প্রদায় (ওহাবী) জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ ও উত্তেজনা সৃষ্টির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিল।” তাঁর ভাষায় বলতে গেলে— “A mischievous sect of Muhammadans under one Keramat Ali, was detected in the endeavour to sow the seed of disaffection.”

Leave a Reply