লেখিকা: তন্বী নওশীন
শিরীন বানু মিতিল আমার মা। এর চেয়ে সুন্দর কোন সত্য আমার জীবনে নেই। এর চেয়ে গর্বের কোন পরিচয় আমার নেই। এই মানুষটা ছিলেন একজন “মানুষ”। অনেক বিশেষণ এখানে বসানো যেতে পারে। মাকে তো আমি সেভাবে চিনতাম না। মার সাথে যারা কাজ করেছেন তারা মাকে অনেক ভাল চিনতেন। মার সাথে যারা বেড়ে উঠেছেন- তাঁর ভাইবোনেরা, তাঁর বন্ধুরা- তারা তাকে চিনতেন একভাবে। তাকে যারা বেড়ে উঠতে দেখেছেন তারা তাকে চিনেন নিশ্চয়ই আরেকভাবে।
আমি অনেক ভাগ্যবতী যে আমি এই মানুষটির গর্ভে জন্মগ্রহন করেছি। আর সত্যি বলতে সেই কারনেই তার বিশেষত্ব যে কি তা বুঝে উঠতেই লেগে গেছে অনেকটা বছর। পৃথিবীতে দুই রকমের মানুষ আছে- অথবা মানুষের দুই রকম আছে। এক হল যা কিছু নিজের তাইই শ্রেষ্ঠ। আরেক হল আমার যা তা আর অন্য দশজনের মতই অতি সাধারন। যারা আমাদের পরিবারকে চিনেন- নানা-নানীর গল্প জানেন, মাকে চিনেন- তারা জানেন যে এই মানুষগুলো ছিলেন দ্বিতীয় রকমের। তারা মাটির সাথে মিশে চলতে পছন্দ করতেন। নিজেদের খুব বড় কোন কিছু থাকলেও তা নিয়ে গর্ব না করাটাই গর্বের, বিনয়ই সত্যিকারের আত্মমর্যাদার- এই মানসিকতার চর্চা এই পরিবারের মানুষদের। সেই কারনে মাকে চিনতে এবং তা নিয়ে গর্ব বোধ করতে আমার বেশ অনেকটা বড় হতে হয়েছিল এবং স্বাধীন চিন্তা তৈরী হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
মার যে পরিচয়ের জন্য সবাই তাকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করত তা হল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রহাতে রনাঙ্গনে যুদ্ধ করা নারী যোদ্ধা। মা কখনো এই বিষয়টি খুব অসাধারন কিছু বলে মনে করতেন না। তিনি চমকপ্রদ, রোমাঞ্চকর বা অসাধারনত্ব দেখানোর জন্য যুদ্ধে জাননি। তিনি ছিলেন একজন সামগ্রিকভাবে দায়বদ্ধ মানুষ এবং অপ্রয়োজনীয় সামাজিক শৃঙ্খল-যা সমাজ বিভিন্ন ছুতায় আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় তা থেকে মুক্ত। তাই মার কাছে যুদ্ধে যাওয়া ছিল নিজের আত্মপরিচয়ের প্রতি সৎ থেকে সামনে যা কর্তব্য তা পালন।
মেয়ে হিসেবে যেই অসুবিধা টুকু সামনে আসে বা সমাজ চাপিয়ে দিতে চায় সেই বাধাটুক পেরোনো তাঁর কাছে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আমি এতবছর পর সেভাবেই বুঝি। সেকারনে মা তাঁর নিজের গল্প বলতে চাইত আরো অনেক মেয়েকে প্রেরণা দেয়ার জন্য। মা নিজের কথা বলার সুযোগটুকু ব্যবহার করতে চাইত আরো অনেক নারীর গল্প বলার জন্য। মা নিজের অসাধারন গল্পটাকেও সত্যিই বিশ্বাস করত আর দশজনের মতই সাধারন বলে। তাই তিনি কোনদিন তাঁর গল্পটা, তাঁর পরিচয়টা বিক্রির চেষ্টা করেননি। সবার উপর ছাপিয়ে গিয়ে নিজে বিশেষ হবার চেষ্টা করেননি। মা মারা যাবার পর অনেকেই বলছিলেন উনার সম্পর্কে জানতাম না কেন, উনি কেন জাতীয় পুরষ্কার পাননি বা উনি কেন আরও উদযাপিত না- সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর এটুকু থেকে বোঝা যেতে পারে।
আমরা এমন একটা সময়ে বাস করি যখন নিজেকে বড় করে দেখানোটাই নিয়ম। পাঁচ দিয়ে গুনে গুনে পঁচিশ আদায় করাটা টিকে থাকার জন্য জরুরী। সেই কারনে এটা খুব স্বাভাবিক যে মার এই সাধারনের সাথে মিশে চলাটা অনেকেই বুঝতে পারননা। আমি সেকারনেই এই কথাগুলো স্পষ্ট করছি। মা মারা যাবার পর দেখলাম অনেকেই বেশ মেলোড্রামা করে বলছেন- উনি স্বীকৃতি পাননি দেখে খুব অভিমানে চুপ করে গেছেন। বড় কষ্ট নিয়ে চলে গেছেন।
না। তেমন মানুষ তিনি ছিলেনই না। মা সেরকম বিশেষ তো হতেই চাননি। অভিমান কিসের? হ্যাঁ, যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়ে তার কষ্ট ছিল। দেশে স্বাধীনতার পর স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান নিয়ে তার কষ্ট ছিল। দেশে বীরাঙ্গনাদের প্রতি সমাজের অন্যায় আচরন নিয়ে তার কষ্ট ছিল। তিনি সেই কষ্ট নিয়ে লড়াই করে গেছেন। তিনি ৭১ ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি নারীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সারা জীবন কাজ করে গেছেন। শিরীন বানু মিতিল অভিমান, কষ্ট, স্বীকৃতির অভাবে চুপ করে থাকা কোন অগভীর নাটকিয় চরিত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন শেষ সময় পর্যন্ত তার বোধ, তাঁর লড়াইয়ের প্রতি সৎ থাকা একজন লড়াকু মানুষ।
আর হ্যা, তিনি ছিলেন অসম্ভব বড় মনের একজন মানুষ। মানুষের প্রতি তার ভালবাসা ছিল আশ্চর্য হবার মত। সেই গল্প আমার চেয়ে যারা তার কাছে এসে সেই নিঃস্বার্থ ভালবাসার পরিচয় পেয়েছেন তারাই বলতে পারবেন। আমরা যেই সময়ে বাস করি- সেরকম সময়ে আমার মার মত মানুষেরা রূপকথার গল্পের নায়কের মত। আজ তার মৃত্যু বার্ষিকীতে তার ভালবাসার যারা, যারা তাকে ভালবেসেছেন, তার কাছে এসেছিলেন- তাদের সবাইকে সেই রূপকথার গল্পের মত মানুষটিকে মনে করিয়ে দেয়া- তাকে নিয়ে সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতিটা স্মরন করিয়ে দেয়া আর একটু হলেও তার মত হতে চাওয়ার ইচ্ছাটুকু জাগিয়ে রাখা- এটুকুই আমার এই লেখার উদ্দেশ্য।