বাংলা-বুলির আপন পুঁজি

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

বাংলা ভাষায় যত সব শব্দ আছে, তাহার ভিতর কতকগুলি তাহার নিজস্ব, কতকগুলি ওয়ারিস সূত্রে পাওয়া, আর কতকগুলি ধার করা। ঢেঁকি, ডাঙ্গা, নে’টা, খাঁটি, ডোঙা এই ধরণের শব্দগুলি নিজস্ব। হাত, পা, আমি, তুমি, করে, দে’খে—এই ধরণের অনেক শব্দ উত্তরাধিকারী হিসাবে সাবেক আৰ্য্য ভাষা হইতে পাওয়া। হস্ত, চরণ, টেবিল, চেয়ার, চাবি, কামরা, কমর, বগল, হরতন, কুড়ি, মােটা শব্দগুলি ধার করা। ধার স্বদেশে বিদেশে। স্বদেশে আর্য্য, কোল, দ্রাবিড় ও ভােট বর্ম্মা ভাষা থেকে। বিদেশে পারসী, পারসীর ভিতর দিয়া আরবী ও তুরকী, আফগানী, পর্তুগীয, ফরাসী, ওলন্দাজ ও ইংরেজীভাষা থেকে। ধার করা শব্দ বাদ দিলে যাহা থাকে, তাহাই বাংলা-বুলির আপন পুঁজি।

ধার স্বদেশে হউক বা বিদেশে হউক, কখনই বড়াই করার বিষয় হইতে পারে না। কতক ধার দরকারী আর কতক বে-দরকারী। যেখানে বাংলার নিজের পুঁজি নাই, সেখানে ধার না করিলে চলে না। ধরুন গােলাপ, আতর, কাগজ, কলম, চশমা, কোর্মা, কালিয়া, বন্দুক, পেনসিল, রেল, মটর, রেডিও, চা, তামাক, চিনি—এসব ছাড়া সভ্য বাঙালীর চলে না, বাংলা ভাষারও চলে না। কিন্তু যেখানে খাঁটি বাংলা শব্দ ছিল বা আছে, তাহা ছাড়িয়া ধার করিতে যাওয়া শুধু বে-দরকারীই নয়, বাংলাভাষার ইজ্জত নষ্ট করাও বটে। সংস্কৃত হইতে ধার করা কি আর আর ভাষা হইতে ধার করা, সবই প্রায় এক কথা, ধার ধার-ই। এখানে দু’টী কথা মনে রাখা চাই। যেখানে অন্য ভাষা হইতে ধার করা শব্দ বাংলায় চলতি হইয়া গিয়াছে, সেখানে ধার তামাদি; কাজেই বাংলার নিজস্ব সম্পত্তির ভিতর গণতি করা যায়। এখানে নূতন করিয়া সংস্কৃত হইতে ধার করা ঠিক নয়। চলিত বাংলায় আঙ্গুরের বদলে দ্রাক্ষা, গরমের বদলে তপ্ত, চাকরের বদলে ভৃত্য, হাজারের বদলে সহষ, কলমের বদলে লেখনী, উকিলের বদলে ব্যবহারজীবী, বাগানের বদলে উদ্যান, রেলের বদলে লৌহবর্ত্ম, চেয়ারের বদলে কাষ্ঠাসন, স্টীমারের বদলে বাষ্পীয় পােত ব্যবহার করা গোঁড়ামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে যখন নূতন ধারের দরকার হইবে তখন সংস্কৃতের ভাণ্ডার হইতেই আমরা ধার করিব। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার নাড়ীর সম্পর্ক আছ, কাজেই এ ধারে কোন দোষ নাই। কিন্তু চলিত বাংলায় নাক, কাণ, দুধ, ঘি, ভাই, বােন এই ধরণের শব্দের জায়গায় নাসিকা, কর্ণ, দুগ্ধ, ঘৃত, ভ্রাতা, ভগিনী, বসান বাংলাভাষার উপর বড় রকম জুলুম করা হয়। ইংরেজী ভাষায় nose, car, milk, butter, brother, sister শব্দগুলির আর কোনও প্রতিশব্দ নাই। কিন্তু তাই বলিয়া কি ইংরেজী গদ্য কি পদ্যের কোন হানি হইয়াছে?

ভদ্র হইবার অন্ধ মােহ আমাদিগকে এমনই পাইয়া বসিয়াছে, যে হালেই আমরা অনেক খাঁটি বাংলা শব্দের জায়গায় সংস্কৃত শব্দ বসাইতে আরম্ভ করিয়াছি। সংস্কৃতের ভক্তেরা ইহাতে আনন্দিত হইবেন সন্দেহ নাই; কিন্তু বাংলার ভক্তেরা ইহাতে খুশী হইতে পারেন না। যেমন দেখুন মিঠে, মউ, ভােগ, নাওয়া, পড়ুয়া, রসুই, পরখ, মিছা, উনই, শির-দাঁড়া, বুলি, ভূঁই, সাথী, পিয়াস, কলিজা, প্রভৃতি শব্দগুলি আজকাল প্রায় শােনা যায় না। স্বদেশী বিদেশী ধার যত বাড়িয়া চলিয়াছে, ততই বাংলা ভাষা আপন পুঁজি হারাইতে বসিয়াছে। এই সকল হারান ধন ফের বাংলায় চালান ঠিক কিনা সে বিচারের ভার বাংলা ভাষার ভক্তদের উপর ছাড়িয়া দিয়া আমি নীচে নমুনার জন্য কয়েকটা হারান শব্দের ফর্দ্দ দিতেছি। বলা বাহুল্য শগুলি সাবেক আমলের বইয়ে পাওয়া যায়।

আউল  –  আকুল ; আড়  –  প্রস্থ ; আথ  –  অস্ত ; উনই  –  উৎস ; উভ  –   উর্দ্ধ ; উরা  –  উরু ; ওর  –  অপর পার ; কাউ  –  কাক ; কান্দরা  –  উপত্যকা;  কিরা  –  শপথ;  খরা  –  রৌদ্র ; খাঁখার  –  কলঙ্ক; খিল  –  অনুর্বর; গহরা  –  গভীরতা; গাড়  –  গর্ত্ত; গুফা  –  গুহা; গােড়ায়  –  পিছে পিছে যায়; ছাপাক  –  মুদ্রাকর; ছেলি  –  ছাগল; জাঙ্গ – জঙ্ঘা; জারুয়া – জারজ ; জুঝার – যোদ্ধা; ঝাট – শীঘ্র ; তিঅজ/তেয়জ – তৃতীয় ; দড় – ‍দৃঢ়; দারী – বেশ্যা; দুয়জ/ দোঅজ – দ্বিতীয়; দেউল – দেবালয়; ধাড়ি, ধাড়ী – আক্রমণ; ধুনি – ধ্বনি; নই – নদী; নহলী – নূতন; না – নৌকা; নিবড়ে – শেষ হয়; নিয়ড় – নিকট; পড়িনাতি – প্রপৌত্র; পড়ুয়া- ছাত্র; পাটি – সিংহাসন; বউল- বকুল; বাগ ডোর – বয়া; বাহ – বাহু; বেজ – বৈদ্য ; ভারুই – ভরত পক্ষী; ভোখ – বুভুক্ষা ; মু – মুখ; ‍মুজড়ী – সীল আংটি; মুদা – মুদ্রা, Seal; মো – মমতা ; রাতা – রক্তবর্ণ; রায় – রাজা; লুুকি – লুক্কায়িত; শিয়ল – শীতল; শিরদাঁড়া – মেরুদণ্ড; শোষ – পিপাসা; সআল – সকল; সাঝা – ভাগ; সানা – সন্নাহ; সাপুড়া – সম্পুট, কৌটা; সায়র – সাগর; সিঞ্চড়া – শিহরণ; সুরুজ – সূর্য – শয্যা; সোঁঅরে – স্মরণ করে; হরিড়া – হরিতকী; হাইবাস – অভিলাষ; হাপুতি – পুত্রহীনা; হুনে – হোম করে।

বিদেশীর পাল্লায় কতকগুলি খাঁটি বাংলা শব্দ এখন ভাষা হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে। নীচে তাহাদের একটি ফর্দ্দ দিতেছি। ইহাদিগকে ফের ঘরে তুলিয়া আনা যায কিনা, বিচার করা দরকার।

আলবাটী – পিকদান; আহিড়ি – শিকারী; কড়িআলি – লাগাম; কাকতলি – বগল; কামিনা – কারিগর; কুকড়া – মোরগ ; কুকড়ী – মুরগী; কোঞ্চা- চাবি; গোহারি- নালিশ; ঘোড়াশাল- আস্তাবল; চেয়াড়- তীর; জোখ -ওজন; টুটা – কম; টুটে – কম হয়; পেড়ি – বাক্স; বাপুড়া – বেচারা; বুহিত – জাহাজ; বেরুণীয়া – মঞ্জুর ; মাঝা/মাঝ – কমর; মেলানি – বিদায়; রঙ্ক – গরীব, শশানু – খরগোস; সয়চান/ সাচান – বাজ পাখী।

টীকা: অভিভাষণটি ১৯৩৬ সালে ( ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ) চন্দনপুরে অনুষ্ঠিত বিংশ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে পাঠ করা হয়েছিল।

 

Leave a Reply