জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের এই সাক্ষাৎকারটি উত্তরণ পত্রিকায় ছাপা হয়। আহমদ ছফা এবং কাজী আকরম হোসেন এই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের সঠিক তারিখ এই মুহুর্তে আমাদের জানা নেই। সাক্ষাৎকারটির কোন বানান পরিবর্তন করা হয়নি।– বাংলাদেশ অন রেকর্ড সম্পাদক
সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কিত কতিপয় বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতামত উত্তরণের এই সংখ্যাটিতে তুলে ধরছি রাজ্জাক সাহেবের বয়স হয়েছে। বেশ কিছুদিন থেকে শরীরটিও ভালো নেই। সাধারণত: বাড়ির বাইরে কোথাও যান না। একনাগাড়ে কথা বলতে গেলে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমাদের প্রত্যাশা ছিলো অর্থনীতি-রাজনীতিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রশ্নে সাম্প্রতিককালে তাঁর মনে কি ধরনের ভাবনা চিন্তা জন্ম নিচ্ছে সেগুলো পাঠকের কাছে নিবেদন করব।
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে এই সময়ে গ্রন্থিল রাজনীতি-অর্থনীতি সম্পর্কিত বিষয়গুলো উত্থাপন করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হয়েছে। আমরা রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছিলাম। শুরুতেই তিনি একটা ছোট রসিকতা করেছিলেন। দিল্লীর বাদশাহ রামমোহনকে রাজা খেতাব দিয়েছিলেন। দিল্লীর বাদশাহর বার্ষিক পেনশন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধে বৃদ্ধির ওকালতি করার জন্য তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল এবং ইংল্যান্ড যাত্রার পূর্বে তাঁর ভদ্র পরিচয়ের চিহ্ন স্বরুপ রাজা টাইটেলটি দেওয়া হয়েছিল অথচ দিল্লীর সম্রাটের কোন রাজত্ব সেই সময় ছিলোনা।ইংরেজ রেসিডেন্ট তাঁর লালকেল্লার কর্মকাণ্ডও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি ইংরেজদের কাছ থেকে বার্ষিক পেনশন পেতেন।বিনিময়ে ইংরেজরা তাঁর সম্রাট পদবীটি রেখে মেনে নিয়েছিলো। রামমোহন সাম্রাজ্যহীন সম্রাটের দেয়া খেতাবটি সারা জীবন ধারণ করে রইলেন, এটা খুবই আশ্চর্যের!
রামমোহনকে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেন| তাঁকে আধুনিক ভারতের জনক বলা হয়ে থাকে। জাতীয় অধ্যাপক রাজ্জাক এই মূল্যায়ন সঠিক বলে মনে করেন না ।তাঁর মতে রামমোহনের সমস্ত চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ধর্ম ।তিনি যা কিছু লিখেছেন তাঁর সিংহভাগই ধর্মবিষয়ক। ভারতবর্ষে এই ধরণের ব্যক্তিত্ব রামমোহনের পূর্বেও ছিলেন বরং বলা যেতে পারে রামমোহন রায় এই ধারার শেষ প্রতিনিধি।
অধ্যাপক রাজ্জাক রামমোহন যা বলেছেন, তার চাইতে যা করেছেন তাকেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। রামমোহন ধর্মের কথা বলেছেন। কিন্তু লিখেছেন বাংলাভাষায়। এটাই রামমোহনের জীবনের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব। রামমোহন রায় আরবী, ফার্সী, সংস্কৃত এবং ইংরেজী ভাষায় অসাধারন ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন ।কিন্তু লিখবার সময় ডানে বামে না তাকিয়ে বাংলা ভাষাটিকেই অবলম্বন স্বরূপ গ্রহণ করেছিলেন। এটা একটা অচিন্তিত পূর্ব ঘটনা। সে যুগে কেউ বাংলা ভাষায় লিখছে এ কথা চিন্তা করাও একরকম অসম্ভব ছিলো। রামমোহন রায় বাংলা ভাষার মাধ্যমে লিখতে শুরু করে একটি অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার নয় বাংলা ভাষা চর্চাই তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিস্তম্ভ।
অধ্যাপক রাজ্জাক আরো বলেন উনবিংশ শতকে ইংরেজ রাজত্বের একটি অন্যতম প্রধান ঘটনা হলো দেশীয় ভাষা (ভার্নাকুলার ) সমূহের উত্থান। রামমোহনের পূর্বে দিল্লীর দরবারে, অযোধ্যায় এবং আরো কতিপয় ক্ষমতাকেন্দ্রে দেশীয় ভাষার চর্চা হতো। ঐ চর্চা শুধু কতিপয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিলো। কাব্য, কিংবা রোমান্স রচনা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে দেশীয় ভাষাসমূহের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। একমাত্র রামমোহনই দেশীয় ভাষাকে সিরিয়াস চিন্তা-ভাবনার বাহন হিসেবে রুপদান করেছিলেন।
আমাদের পরবর্তী প্রশ্ন ছিলো পণ্ডিত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে । অধ্যাপক রাজ্জাক বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বিদ্যা-বুদ্ধি, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা এবং সাহসের উনিশ শতকের একজন নায়ক-পুরুষ মনে করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করলেন। বিদ্যাসাগর বাঙালী বলতে বাঙালী হিন্দুকেই বুঝতেন। বাংলার মোট জনসংখ্যার অর্ধাংশ যে মুসলমান ঘুণাক্ষরেও এ চিন্তা তাঁর মনে উদয় হয়নি। বিধবা বিবাহ, শিক্ষার প্রসার এ জাতীয় নানা কল্যাণমূলক কর্মের মধ্যে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, চরিত্রের বলিষ্ঠতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনা। কিন্তু তিনিও বাঙালীর কল্যাণ বলতে বাঙালী হিন্দুদের কল্যাণ বুঝতেন।
পরে আমরা তাঁর কাছে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে উনিশ দশকের [শতকের] বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা কোন চোখে দেখেছিলেন সে বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বলতে অনুরোধ করি।তিনি বললেন, উনিশ শতকের যে সকল বাঙালি বুদ্ধিজীবী ১৮৫৭ সালের দিকে নানা সামাজিক ভূমিকা পালন করেছিলেন ঘেটে তাঁদের একটা তালিকা প্রস্তুত করে যাচাই করে নিতে পারেন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এই সকল ব্যক্তির মধ্যে বেশির ভাগ চুপ করে ছিলেন দুএকজন ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ বিশেষ কিছু বলেননি। এই রকম একটি বিশাল ব্যাপক ঘটনায় তাঁদের কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হলোনা, এটা খুবই দুঃখের বিষয়। তাঁর মতামতের সারকথা হলো উনিশ শতকের বাঙালী বুদ্ধিজীবিরা ব্রিটিশকেই সমর্থন করেছিলেন। এ বিষয়ে অধিক সংবাদ জানার জন্য তিনি রিচার্ড টেম্পলের স্মৃতিকথাটি পড়তে পরামর্শ দিলেন।বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে নাকি পাওয়া যাবে।
আমাদের পরবর্তী জিজ্ঞাসা ছিল উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সমাজকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল সে সম্পর্কে । প্রত্যুত্তরে জাতীয় অধ্যাপক একটা সহজ দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলেন। সমাচার দর্পণ, তত্ত্ববোধিনী, বঙ্গ দর্শন ইত্যাদি যে সকল সাময়িক পত্রিকা শিক্ষিত বাঙালীর মনন চর্চার ফসল হিসেবে গড়ে উঠেছিল সেগুলোর প্রচার কতদূর বিস্তৃত ছিলো তার একটা হিসাব নিতে বললেন। তিনি জানালেন, কোন পত্র-পত্রিকাই পাঁচশো কপির বেশী ছাপা হতোনা। শহর কলকাতার বাইরে ঐ সকল পত্র-পত্রিকা বিলি হতোনা বললেই চলে। বঙ্কিমের উপন্যাস সমূহও ঐ একই পর্যায়ের মধ্যে পড়ে।মাত্র মুষ্টিমেয় মানুষই এই নতুন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আওতাভুক্ত ছিলো।
অন্যদিকে বটতলার পুঁথি সমূহ হাজারে হাজারে মুদ্রিত হতো এবং বৃহত্তর বাংলার সবখানে ছড়িয়ে যেত। এ বিষয়ে বিশদ জানার জন্য কোলকাতার পরিবর্তন পত্রিকার সম্পাদক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বইটি পড়তে বললেন। বইটির নাম সেই মুহূর্তে মনে করতে পারলেন না । এই পুঁথি সমূহ বৃহত্তর বাংলার জনগণের রস পিপাসা মেটাতো।
বাঙ্গালী সমাজের উপর উনিশ শতকের শিক্ষিত ব্যক্তিদের নানা সাংস্কৃতিক প্রয়াসের চাইতে এই পুঁথিসমূহের প্রভাব অনেক বেশি। তবে পুঁথিগুলোর ঋণাত্মক দিক এই যে তাতে আধুনিক চিন্তার কোনো স্ফূরণ ঘটেনি। তবে একথাও সত্য যে ঐ পুঁথিসমূহ ছিল যথার্থ অর্থেই সেক্যুলার। বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটির চাষ উনিশ শতকের শিক্ষিত ব্যক্তিরাই সর্বপ্রথম করেছিলেন।
আমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁকে কিছু বলতে বললাম। রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে তিনি খুবই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য রাখলেন। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ বিরাট প্রতিভা, খোদা প্রদত্ত অসীম ক্ষমতার অধিকারী। যা-ই বলেছেন, মানুষের মর্মে ঘা দিয়ে বাজিয়ে তুলেছেন। এই অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে তো আর আলোচনা চলে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ সমূহে যে সুস্থ কাণ্ডজ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছে জাতীয় অধ্যাপক তার খুব তারিফ করলেন। তবে ব্যক্তি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো বড় বড় ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি স্থান পাওয়ার যোগ্য কিনা সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন।
রবীন্দ্রনাথের পর আমরা কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে আসি।কাজী কবির প্রতি জাতীয় অধ্যাপকের এক ধরণের দুর্বলতা যে রয়েছে তা কারও দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার মতো নয়। যাহোক, তিনি বললেন, অনেকেই যে রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের তুলনা করেন এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই আর নজরুল নজরুলই। জনপ্রিয়তাকে সাহিত্যের একটা গুন বলে অনেকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনা। এটা ঠিক নয়। জনপ্রিয়তা সাহিত্যের উপক্ষেণীয় বিষয় নয়। সে দিক দিয়ে বিচার করলে নজরুলের কবিতা, নজরুলের গানকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মানদণ্ডে বিচার করতে হবে। যেকোন নান্দনিক সৃষ্টিকর্মকে জনগণের অনুভবের আওতায় এনে দিতে পারা, কম কথা নয়। নজরুলের গান সেকালে অত্যন্ত অল্পসময়ের মধ্যে যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো বৈষ্ণব পদাবলী ছাড়া অন্য কোন বাঙালী সংগীত স্রষ্টার সঙ্গে তার তুলনা চলেনা। বৈষ্ণব পদাবলীও একদিনে বা একবছরে কিংবা একজন কবির প্রচেষ্টায় হঠাৎ করে সমাজের গভীরে প্রবেশ করেনি। একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি হতে পেরেছে। তার সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু নজরুলের গান একেবারে হঠাৎ করে জনগণের গভীর সংবেদনায় নাড়া দিয়ে বসে। জাতীয় অধ্যাপক তাঁর ছাত্র জীবনের কথা উল্লেখ করে জানালেন, আমরা ছাত্র থাকার সময় ঢাকা শহরের ঘোড়ার গাড়ির প্রতিটি গাড়োয়ানের মুখে মুখে ফিরতো নজরুলের গান। বাংলার কোন সংগীতস্রষ্টার ভাগ্যে এটা ঘটেনি। নজরুল অনুরাগ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মনে এত গভীর যে ঘন্টার পর ঘন্টা অবলীলায় বলে যেতে পারতেন । কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে আমাদের রাশ টানতে হলো। তাঁর সঙ্গে আরও নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। আশা আছে সময় ও সুযোগমতো আগামীতে প্রকাশ করব ।
4 Comments
Sohel Rana
July 23, 2020তথ্য সমৃদ্ধ এইরকম লেখা নিয়মিত পড়ার আগ্রহ রইলো
Abbie
August 4, 2020If some one wishes to be updated with most up-to-date technologies afterward he must be pay a visit this
site and be up to date daily.
Lionel
August 7, 2020I am regular reader, how are you everybody? This paragraph posted at this website is
really good.
Look into my webpage: RoyalCBD.com
Salvador
August 9, 2020My partner and I absolutely love your blog and find almost all of
your post’s to be what precisely I’m looking for.
can you offer guest writers to write content for
yourself? I wouldn’t mind publishing a post or elaborating on some of the subjects you write related to here.
Again, awesome blog!