শশীভূষণ দাশগুপ্ত
বাঙলা দেশ পয়ার ছন্দের দেশ। বাঙলা সাহিত্যের প্রথম থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত যত কাব্য-কবিতা রচিত হয়েছে, তার বারাে আনারও বেশি পয়ার ছন্দে ; ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথেরও প্রধান ছন্দ পয়ারই বটে। শুধু সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, ধর্ম এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও দেখতে পাই সেই পয়ারেরই প্রভাব।
পয়ার ছন্দের প্রধান পরিচয় তার ভিতরকার সর্বাঙ্গীন তানধর্মে। সেখানে কোনাে মাত্রার কোনাে ধ্বনিই একক বা স্বতন্ত্রভাবে সার্থক নয় – সব জুড়ে জাগে একটি তান, আর সেই একতানের ভিতরেই ছােট-বড়াে সকল ধ্বনি তাদের নিজ-নিজ অস্তিত্বকে ডুবিয়ে দেয়। এই একতানতার পশ্চাতে রয়েছে একটি প্রকাণ্ড শােষণ শক্তি – সেই শোষণ শক্তিই ছােট বড় ব্যক্তিকে একেবারে স্বতন্ত্র বা উৎকেন্দ্রিক হয়ে পড়তে দেয় না – ছােট-বড় সকলকে জড়িয়ে একতানের সৃষ্টি করে। কিন্তু এ-কথা মনে করলে ভুল করা হবে যে, এই একতানতা শব্দের অর্থ, গুরুর গুরুত্ব অস্বীকার করা ; চরণের ভিতরে গুরু মাত্রা থাকলে সে মাত্রাটি নিজেই ভয়ানক ভাবে গুরু হয়ে উঠবার সুযােগ পায় না বটে, কিন্তু সে সমগ্র চরণের গুরুত্ব নানাভাবে বৃদ্ধি করে।
ঠিক তেমনি ভাবে বাঙলা দেশের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ভাল করে বুঝে দেখলে দেখতে পাব, প্রাচীন যুগ থেকেই বাঙলা সমাজের একটা অসীম শােষণ-শক্তি আছে। এই জন্যই এখানে যত মত এবং পথ প্রচারিত হােক না কেন, তারা কেউই তাদের উদগ্র স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বেশি দিন টিকতে পারে নি, – জন-সমাজের শােষণ-শক্তি তাদের টেনে ধরেছে ; ছোট বড় মাত্রাগুলির ভিতরে একটা স্বাভাবিক যােগ স্থাপন করে দিয়েছে। তাই যে যুগে যত মত এবং পথই জাঁকিয়ে ওঠুক না কেন, কিছুদিন পরেই দেখি, সমাজ তাকে আপনার মত করে রূপান্তরিত করে নিয়েছে এবং সেই রূপান্তরের ভিতর দিয়েই এসে পড়েছে চমৎকার একতান। তাতে করে ধর্ম বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোনাে মনীষারই অস্বীকার বা অমর্যাদা হয় নি – তাদের মূল্য এবং মর্যাদা সকলের সঙ্গে মিশে জাতীয় জীবনের মূল্য এবং মর্যাদাকেই বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই জন্য বাঙলার কোনাে ধর্মেরই রঙ তেমন চটকদার নয়। পালরাজাদের সময়ে বাঙলার একটা বৃহত্তর অংশ জুড়ে যে বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল, তাকে বৌদ্ধধর্ম নাম দেবার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। আসলে সেটা বৌদ্ধধর্মও নয়, প্রচ্ছন্ন হিন্দুধর্মও নয় – সেটি বাঙলা সমাজের শােষণশক্তির ফলে রূপান্তরিত একটি মিশ্র-রঙ এবং মিশ্র প্রকৃতির নূতন ধর্ম। জনগণের টানা-হেঁচড়ায় পড়ে বুদ্ধদেব কখনও শিবঠাকুরের পিছনে গিয়ে লুকিয়েছেন– কখনও পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের সঙ্গে গলাগলি করে একেবারে একদেহ-একাত্মা হয়ে উঠতে চেয়েছেন ; আবার কখনও সেই ধর্মের ঠাকুরের সঙ্গে শিবঠাকুর একসঙ্গে মিশে গেছেন। বৈষ্ণবধর্মকে বৃন্দাবনের গোসাঁইগণ বিবিধ স্মৃতি ও তত্ত্ব গ্রন্থের ভিতর দিয়ে যতই ‘বিশেষ’ করে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করুন, গােসাঁইগণের গ্রন্থডোরকে ফাঁকি দিয়ে সেই ভক্তিধর্ম বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রূপান্তর গ্রহণ করেছে। বাঙলার শক্তিদেবীকে দিয়ে বাঙালী বাঁশী বাজিয়েছে, বাঙলার কৃষ্ণের জিভ বের করে তাঁর হাতে অসি দান করেছে। বাঙলার মুসলমান ধর্ম আজকের দিনে একটা কৃত্রিম উপায়ে বাঙলার সাধারণ ধর্ম (হিন্দুধর্ম ?/বাঙালী ধর্ম ?) হতে যতই স্বতন্ত্র বলে পরিচয় লাভের চেষ্টা করুক না কেন, বৃহত্তর বাঙালী সমাজ সেরূপ স্বাতন্ত্র্যের সুযােগ রাখে নি। ফলে পণ্ডিত মুন্সীগণ যত উগ্রভাবে হিন্দু এবং মুসলমান হন না, জনসাধারণ কেন এক ‘বাঙালী’।
কথাটির যথার্থ যথার্থ্য বােঝা যায় বাঙলার বাউলের দিকে তাকালে। এই বাউলধর্ম বাঙলার নিজস্ব ধর্ম। সে কথার অর্থ এ নয় যে, বাউলধর্মের ভিতরে যে সকল ভাব এবং কথা রয়েছে তা ভারতবর্ষের আর কোথাও কোন ধর্মে নেই ; বাউলদের যা কথা তা হিন্দুধর্মের বহুস্থানে আছে, মুসলমান ধর্মেও আছে। কিন্তু বাউল ধর্মের বৈশিষ্ট্য এই, এখানে হিন্দুধর্মের অনেক মর্মকথা এবং মুসলমান ধর্মের অনেক মর্মকথা অতি সহজভাবে থিতিয়ে পড়েছে। এই থিতানাের ভিতর দিয়ে তারা যে রূপান্তর লাভ করেছে, সেখানে ধর্মের ক্ষেত্রে বাঙালী-জীবনের একতান নিখুঁত হয়ে উঠেছে। এখানে অদ্বয়ের ভিতরে একটা দ্বৈত-বােধ এবং তাকে অবলম্বন করে যে সংস্কারবিহীন সহজ প্রেম-ধর্মের সুর ভেসে উঠেছে, সেখনে শাস্ত্রবাণী তাদের গুরুত্ব কিছুই হারায় নি – কিন্তু পৃথক মাত্রার উগ্রতা হারিয়ে ফেলেছে।
এই সহজ মিলনের একটি সুন্দর পরিচয় রয়েছে একখানি অখ্যাত কাব্যগ্রন্থে। গ্রন্থখানি আলিরাজা ওরফে কানু ফকিরের রচিত ‘জ্ঞান-সাগর’। কানু ফকির চট্টগ্রামের একজন গ্রাম্য কবি এবং প্রসিদ্ধ সাধক। শাহ কেয়ামদ্দিন-নামক একজন তত্ত্বজ্ঞানী সাধক কানু ফকিরের দীক্ষাগুরু ছিলেন। কানু ফকির প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্বে এই গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন। তিনি যে শুধু কবি নন, যথার্থ সাধকও ছিলেন, তার প্রমাণ গ্রন্থ-মধ্যেই যথেষ্ট পাওয়া যায়। কারণ নিজে সাধক না হলে শুধু কবিত্ব-শক্তির দ্বারা এ-জাতীয় গ্রন্থ রচনা সম্ভব নয়। ‘জ্ঞান-সাগর’ ব্যতীত কানু ফকির এই জাতীয় আরও দু’একখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন–’সিরাজকুলুপ, ‘ধ্যানমালা’ এবং কারও-কারও মতে ‘যোগ-কলন্দর’ গ্রন্থখানিও কানু ফকির-কর্তৃকই রচিত।
এই ‘জ্ঞান-সাগর’ গ্রন্থের ভিতরে আমরা কি দেখতে পাই? এখানে দেখি, বাঙলার জনমন কি করে হিন্দুধর্ম এবং মুসলমান ধর্ম উভয় ধর্মের সাধন-প্রণালীকে শােষণ করে আত্মসাৎ করেছে। নবী বা রসুল (পয়গম্বর) আলির নিকট ধর্মের সকল সারতত্ত্ব উপদেশ করছেন– এই ভাবে গ্রন্থখানি লেখা হয়েছে।
নবী বলে সুন আলি অপরূপ বাণী।
প্রভুর আগমতত্ত্ব সুরম কাহিনী ॥
এখানে প্রথমেই ‘প্রভু’ কথাটি লক্ষণীয়। জগদীশ্বর আল্লা অর্থেই গ্রন্থ-মধ্যে সর্বত্র প্রভু শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটি গ্রহণ করতে মুসলমান ফকিরের যেমন কোনাে আপত্তি নেই, তেমনই এর সঙ্গে হিন্দুদেরও বেশ একটা মনের যােগ রয়েছে। এই প্রভুর বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,
এক কর্ত্তা এক হর্ত্তা এক জীব সার।
নানারূপ জলবিন্দু জগতে প্রচার ॥
এক কায়া এক ছায়া নাহিক দোসর ।
এক তন এক মন আনে একেশ্বর ॥
ত্রিজগৎ এক কায়া এক করতার।
একপ্রভু সেবে জনে সব জীবধর ॥
এটি হিন্দুধর্মের কথা না মুসলমান ধর্মের কথা? বাঙালি সমাজ-মনের ভিতরে এসে এখানে হিন্দুধর্ম ও মুসলমানধর্ম অতি সহজে এক হয়ে মিলে গেছে। পরে আবার বলা হয়েছে ––
সর্ৰ জগ এক সিন্ধু নানা রূপে জলবিন্দু
সর্ৰ স্থানে আছে ব্যক্তময় ।
জথাতথা রহে বারি চলে সর্ৰ স্থান ছাড়ি
সর্ৰ গিয়া সাগরে মজ্জএ ॥
তিন লােকে এক মাটী বর্ণ ধরে কোটী কোটী
পুর্ণী মাটী আখেরে সকল ।
জথা তথা বারি রহে দৃষ্টিগতে ব্যক্ত হএ
মাটি হতে সকল নির্ম্মিল ॥
এর ভিতরেও হিন্দু ধর্ম বা মুসলমান ধর্মের কোন মুদ্রাঙ্কণ নেই –– অথচ কোনাে ধর্মেরই এ কথাকে নিজের কথা বলে গ্রহণ করতে কোথায়ও আটকায় না। হিন্দুধর্মের তরফ থেকে যদি একে সাংখ্য বা বেদান্ত, অথবা সৎকার্যবাদ বা অসৎকার্যবাদ-প্রভৃতি কোনও একটি বিশেষ দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে স্পষ্ট মিলিয়ে নিতে চাই –– তাও পারব না। কিন্তু পণ্ডিত-মুন্সী ছেড়ে বাঙলার যে কোনও সাধারণ হিন্দু বা মুসলমানের নিকট এ সকল কথার অর্থ জিজ্ঞাসা করলে তারা সহজে এবং নিঃসংশয়ে এর অর্থ বলে দেবে। এই ধর্ম-সমন্বয় কোনাে প্রচার-প্রচেষ্টা-জাত সমন্বয় নয়, এটি সমাজ-জীবনের সমন্বয়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-সমন্বয় –– এটি একই সমাজজীবনের মর্মবাণী। তাই একেই আমরা বলব বাঙালির ধর্ম বাণী।
তারপরে –
তিনলোক একসর এক প্রভু গৃহেশ্বর
আর জন সকল সেবক।
সেবকের এক কাম হইবারে অবিশ্রাম
প্রভু ভাবে সেবার ভাবক ॥
এ যেমন একদিকে প্রত্যেক ভক্ত মুসলমান সাধকের মনের কথা, তেমনই প্রত্যেক হিন্দু সাধকেরও মনের কথা। কানু ফকির প্রশ্ন তুলেছেন, সত্যকারের ফকির বা দরবেশ কে ? জবাবে তিনি বলেছেন ––
রত্ন মাটি সমান পারিলে করিবার।
কইছে প্রভু সে ফকির হয় সার ॥
সুগন্ধ দুর্গন্ধ যদি জানে এক সম।
সমান জানিলে লােক উত্তম অধম ॥
নরনারী পশুপক্ষী পতঙ্গ কীটসি ।
সকল সমাজ জানে তবে সে দর্ৰেশী ।
এই সত্য যেমন প্রচার করেছে মুসলমানের শাস্ত্র –– এই সত্যই প্রচার করেছেন উপনিষদের ঋষিগণ –– একস্থানে নয় –– বহু স্থানে, একবার নয় –– একাধিক বার। হিন্দুর প্রিয়তম ধর্মশাস্ত্র গীতা-গ্রন্থের ভিতরেও ত সর্বত্রই রয়েছে –– এই সত্য।
আবার দু-একস্থানে পাই, সকলই শূন্য থেকে –– “শূন্য’ই সারতত্ত্ব।
সংসারে ফকির শূন্য জপে শূন্য নাম।
শূন্য হন্তে ফকিরের সিদ্ধি সর্ৰ কাম ॥
ধাম শূন্য কাম শূন্য শূন্যে যার স্থিতি।
সে শূন্যের সঙ্গে করে ফকির পিরীতি ॥
শূন্যেতে পরমহংস শূন্যে ব্রহ্ম্ঞান ।
যথাতে পরমহংস তথা যোগ-ধ্যান ॥
অথবা,––
শূন্য সূক্ষ্ম তণু হএ রূপ শূন্যকার।
রূপের সাগরে সিদ্ধি জন্ম বণিজার ॥
শূন্য সিন্ধু হন্তে ব্যক্ত রূপের সাগর ।
সিদ্ধিরূপ সাগরে সমস্ত সদাগর ॥
এই ‘শূন্য’ কি? স্বভাবতই বৌদ্ধ ‘শূন্যে’র কথা মনে পড়ে যাবে। কিন্তু ভারতবর্ষে এই শূন্যবাদের প্রচারের পর থেকেই ভারতীয় জনগণ চারিদিক হতে এই শূন্যকে শােষণ করতে চেষ্টা করেছে। দেশজ সাহিত্যের সমৃদ্ধির ভিতর দিয়ে যখন জনগণের কণ্ঠ খানিকটা মুক্ত হল তখন দেখতে পাই, জন-সমাজে গৃহীত হয়ে ‘শূন্য’ তার শূন্যত্ব হারিয়ে ফেলেছে, –– কবীর-দাদূ প্রভৃতি সন্ত কবি, এমন কি মীরাবাঈ-এর মতাে ভক্ত কবিও শূন্য- সমাধির কথা বলেছেন ; উড়িষ্যার পঞ্চশাখার বৈষ্ণব কবিরা বরাবর শ্রীকৃষ্ণেকে ‘শূন্য-পুরুষ’ আখ্যা দিয়েছেন ; আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণু বা রামরূপী ধর্মঠাকুরের সর্বদাই ‘শূন্যমূর্তি’। তাই এদেশের মুসলমান ফকিরের কাছে পরমসত্যও ‘শূন্য’ই বটে। বহু যুগের শােষণের ফলে এ ‘শূন্য’ যে তার ‘বৌদ্ধ-মাত্রা’ পনেরো আনাই হারিয়ে ফেলেছে তা বােধহয় আর প্রমাণ করতে হবে না।
গ্রন্থখানির ভিতরে স্থানে-স্থানে দেখতে পাই, পাণ্ডিত্য-শাস্ত্রজ্ঞান-প্রভৃতির অকিঞ্চিৎকরতা প্রদর্শন করে প্রেম-যােগের পথকেই বড় করে দেখানাে হয়েছে। ভারতের ধর্মসাধনার ইতিহাসে এই সুরটি ও জনগণের বহুদিনের একটি বিদ্রোহী সুর। যােগ-সাধনার দিক হতে এবং প্রেমসাধনার দিক হতে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সহজিয়া বা মরমিয়া সম্প্রদায় জনসাধারণের পক্ষ হতে শাস্ত্রবাদী পণ্ডিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এই কথা বলে এসেছে। এখানেও পাই সেই সুরের সঙ্গেই সঙ্গতি।
শাস্ত্র সব ত্যাগ করি ভাবে ডুম্ব দিয়া।
প্রভু প্রেমে প্রেম করি রহিবে জুড়িয়া ॥
আবার,––
ত্রিলােক প্রভুর তনু লীলা কোন মতে।
পণ্ডিতের শক্তি নাহি সে তত্ত্ব বুঝিতে ॥
এ-সম্বন্ধে সব চেয়ে সুন্দর আলােচনা রয়েছে যেখানে কবি ‘অক্ষরের’ পাঠ এবং ‘প্রেমের পাঠ’-এর তুলনামূলক বিচার করেছেন।
অক্ষরে জগতের শাস্ত্র করিছে লিখন।
প্রেম পাঠ সম এক নহে কদাচন ॥
সার নহে অক্ষর জথেক শাস্ত্রকুল।
পড়িয়া পণ্ডিত সিদ্ধা প্রেম পাঠমূল ।
শাস্ত্র পাঠ অক্ষরে না পরে সিদ্ধি সাধ।
হৃদিমূলে পাঠ পড়ি পণ্ডিত বিখ্যাত ॥
অক্ষরে পাঠ পড়ে চর্ম্ম চক্ষে দেখি।
প্রেমপাঠ প্রকাশিত হৃদান্তরে আঁখি ॥
… … …
সংসার অক্ষর শাস্ত্র অসার সকল।
পরম আগম প্রেমপাট সিদ্ধিফল ॥
শুকা কাষ্ঠ তুল্য জথ অক্ষর লেখা।
পরম পিরীতি পাঠ রস-সিন্ধুময় ॥
চারি বেদ চৌদ্দ শাস্ত্র জথ পাট অক্ষর।
ব্যক্ত সব পাঠ শুকা কাষ্ঠ সমস্বর ॥
পরম প্রেমের পাঠ গম গােপত।
গুপ্ত প্রেম পাঠ পড়ি সিদ্ধি মুক্তিপদ ॥
এই যে প্রেমের পাঠ এটিই সূফীধর্মের মূলকথা। কিন্তু এই সূফীধর্মের সঙ্গে এখানে মিশে গেছে ভারতের সকল সহজিয়া বা মরমিয়া সাধকগণের মর্মবাণী।
বৌদ্ধ সহজিয়া সরহপাদ বলেছেন,––
পােথি পঢ়ি পঢ়ি জগ মুবা পংডিত ভয়ান কোই।
একৈ অস্মির পীব কাপঢ়ৈ সুপংডিত হােই ॥
‘পুঁথি পড়িয়া পড়িয়া জগৎ মরিয়াছে, পণ্ডিত হইল না কেহ ; যে পড়ে প্রিয়ের একটি অক্ষর সেই হয় সুপণ্ডিত।’
দাদূ বলেছেন, ––
পঢ়েন্ পাবৈ পরমগতি পঢ়ে ন লংঘৈ পার।
পঢ়ে ন পঁইচে প্রানিয়া দাদূ পীর পুকুর ॥
… … …
পঢ়ি পঢ়ি থাকে পংডিতা কিন্হূঁ ন পায়া পার।
মসি কাগদ কে আসিরে ক্যােঁ ছুটৈ সংসার ॥
কাগজ কালে করি মুয়ে কেতে বেদ কুরাণ ।
একই অঙ্মির প্রেম কা দাদূ পঢ়ৈ সুজান ॥
‘পড়িয়া পাওয়া যায় না পরম গতি, পড়িয়া লঙ্ঘন করা যায় না পার ; পড়িয়া পৌছায় না প্রাণীরা ; হে দাদূ, অন্তরের বেদনায় ডাক তাঁকে।… পড়িয়া পড়িয়া হয়রান হইল পণ্ডিত, কেহই তাে পাইল না পার, কালী কাগজের ভরসায় কেন ছুটিয়া চলিছে সংসার ? কাগজ কালা করিয়া করিয়া মরিল কত বেদ-কোরাণ ; একটি অক্ষর প্রেমের যে পড়িল, হে দাদূ, সেইত পণ্ডিত সুজন।’
একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাব, ভারতীয় বিভিন্ন যুগের জনগণের কবিদের সহিত আমাদের সুদুর চট্টগ্রামে একজন বাঙালি কবিও কেমন সুন্দর করে তাঁর সুর মিলিয়ে দিয়েছেন।
সমস্ত বাঙালি মুসলমান ভক্ত কবি –– শুধু বাঙালি নয়, ভারতীয় সমস্ত মুসলমান ভক্ত কবিই সূফী মতাবলম্বী। তার কারণ, মতের দিক থেকে এবং পথের দিক থেকে সূফী ধর্মের সঙ্গে ভারতীয় মনের
একটি নিগূঢ় যােগ রয়েছে। এই ভারতীয় মনের প্রভাব অনেকখানি পড়েছিল ভারতীয় সূফী ধর্মের ক্রমবিকাশে। আমাদের কবি কানু ফকিরও মূলত সূফী। প্রেম সৃষ্টির আদিম এবং আসল সত্য। প্রেমে যেমন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে, সেইরূপ প্রেমেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড বিধৃত হয়ে রয়েছে। যে পরস্পর আকর্ষণ-বিকর্ষণের ফলে বিশ্ব-নিখিল একটা দুর্লঙ্ঘ্য নিয়মে আবর্তিত হচ্ছে, সেই আকর্ষণ-বিকর্ষণ বা সেই বন্ধনই তাে আদি প্রেম।
প্রথমে বহ্নির সঙ্গে বাবির (বায়ুর) পিরীতি।
হইল মাটির প্রেম জলের সঙ্গতি ॥
এ সব প্রেমে যদি মন না ডুবিত।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল আদি কিছু না জন্মিত ॥
গগনের সঙ্গে হইল স্বর্গের পিরীতি।
স্বর্গ সঙ্গে মর্ত্যের পিরীতি আছে অতি ॥
ত্রিভুবনে প্রভু প্রেম আছএ জড়িত।
নরক পাতাল সঙ্গে আছএ পিরীত ॥
মর্ত্ত্যণ্ড চন্দ্রিমা গুরু বৃক্ষ জথ ধরি।
প্রেম হেতু গগন সঙ্গে রহিলেক জড়ি ॥
সাগরের সঙ্গে বারি জল সঙ্গে মীন।
ইন্দু সঙ্গে যামিনী রবি সঙ্গে দিন ॥
প্রেমেতে জগত বন্দী মীন বন্দী মুলে ।
কমলে ভ্রমর বন্দী মীন বন্দী জলে ॥
পুরুষের মন বন্দী নারী প্রেমরসে ।
নারী বিন্দু পুরুষের অসিদ্ধি মানসে ॥
এই প্রেম থেকেই যুগল ভাবনা এবং সেই যুগল ভাবনা থেকেই তাে সকল সৃষ্টি। আপনাতে যেদিন আপনি একা হয়েছিলেন প্রভু সেদিনও নিজেকেই নিজে দেখতে পান নি ; নিজের প্রেমরস আস্বাদনের জন্য তিনি করলেন যুগলের সৃষ্টি।
যুগলভাবনা যদি প্রথমে না হৈত।
করতা এ ত্রিজগতে কিছু না সৃজিত ॥
যুগ ভাবে ভক্তাপ্রভু আপে হইলেস্ত ।
প্রেম হেতু করতা এ জগ সৃজিলেন্ত ॥
প্রেম রসে মগ্ন হইল আপ্নে গোসাই ।
যুগ ভিনে কোন কর্ম্ম সিদ্ধি পন্থ নাই ॥
প্রেম রসে মগ্ন হইল আপনে গোসাই।
যুগ ভিনে কোন কর্ম্ম সিন্ধি পন্থ নাই ॥
… … … …
প্রথমে আছিল প্রভু এক নিরঞ্জন।
প্রেম রসে ডুঅি কৈল যুগল সৃজন ॥
কিন্তু এই প্রেমধর্ম বেশিক্ষন সূফী মতেই নিবদ্ধ রইল না। বাঙলার প্রেমধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সহজিয়া সাধন। আদির’ যুগল প্রেম যে মর্ত্যে ধরা দিয়েছে নরনারীর যুগল প্রেমের ভিতর দিয়ে, সেই যুগল প্রেমের নিঃসীম অনুভূতির ভিতর দিয়েই তো খুঁজতে হবে আদির সর্ব ব্যাপী এক প্রেমকে। তাই বৈষ্ণব সহজিয়াদের সুরে সুর মিলিয়ে ফকির বলেছেন,––
রূপ বিনু প্রেম নাহি ভাব বিনু ভক্তি ।
ভাব বিনু লক্ষ্য নাই সিদ্ধি বিনা মুক্তি ॥
নবী কুলে প্রথম আদম ভক্ত হইল।
হাবা দেবী সঙ্গে রসকূপে ডুবি ছিল ॥
দেবকুলে অতি ভক্ত হইল মহেশ্বর ।
গৌরী দেবী সম্মুখে থাকিত দিগম্বর ॥
… … …
আছিল আয়েসা বিবি পরম সুন্দর ।
সেইরূপে মোহাম্মদ ভক্ত পয়গাম্বর ॥
নর পরী পশু পক্ষী কীট তরুবর ।
প্রেমরস বিনু কার নাই মুক্তিবর ॥
‘জ্ঞান-সাগর’ গ্রন্থখানির ভিতরে এই রুপে কবির লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে বাঙলা দেশের সকল প্রকারের ধর্মমতেই মিশে আছে। এখানে সাংখ্য, তন্ত্র, নাথপন্থ, সূফীমত সব মিশে একাকার হয়ে উঠেছে। নারী-পুরুষের আলোচনার প্রসঙ্গে কবি বলছেন,––
স্থূল্য সাকার কামিনী ত্রিভুবন ।
নৈরাকার পুরুষ সে প্রভু নিরঞ্জন ॥
এখানে মুসলমান সূফী মতে স্থূল সৃষ্টি হল কামিনী, নিরাকার নিরঞ্জন-পুরুষ হলেন পুরুষ । সাংখ্য মতের প্রকৃতি-পুরুষের কথা এখানে স্বতঃই মনে আসে। এটির পরের পদে দেখি,––
বিশ্বরুপী আপনি পুরুষ নৈরাকার।
সাকার কামিনী জথ সমস্ত সংসার ॥
এখানে তন্ত্রের শিব-শক্তি এসে পড়েছে। আমার মনে হয় : ‘বিম্বরূপী’ এখানে ‘বিন্দুরূপী’র রূপান্তরিত অবস্থা । শিবই বৈন্দব তনু, স্থুল সংসার নাদ-রূপিণী শক্তি, –– নাদ-বিন্দুর তত্ত্বটিই এখানে আভাসিত হয়েছে। এর পরের পদ,––
চক্র হয় কামিনী পুরুষ দিবাকর ।
রামাকুল মৃত্যুপদ পুরুষ অমর ॥
ভ্রম হয় রামাকুল পুরুষ চেতন ।
নিদ্রাএ পীড়িত রামা পুরুষ জাগন ॥
এখানেও সাধারণ ভাবে সেই তন্ত্র মতেরই অনুবর্তন দেখছি। বাম-দক্ষিণবহা নাড়ীদ্বয়ই তন্ত্রে চন্দ্র-সূর্য এবং নারী-পুরুষরূপে কীর্তিত। শক্তিই মায়া –– পুরুষ বা শিবই চৈতন্য বা, জ্ঞান-মাত্র-তনু। কিন্তু অন্যত্র এই চন্দ্র-সূর্য সম্বন্ধে দেখতে পাই,––
অমরা সে মরা হএ মরা সে অমর ।
চন্দ্র হএ ভাবক ভাবিনী প্রভাকর ॥
এখানে চন্দ্র সােমাত্বক ভাবক এবং সূর্য অগ্ন্যাত্মক বা সংহারাত্মক ভাবিনী। চন্দ্র-সূর্যের এই তত্ত্ব আমাদের নাথপন্থের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
এই নারী-পুরুষ সম্বন্ধে অন্যত্র দেখি,––
তন হএ কামাকুল জগৎ সংসার ।
মন হএ পুরুষ সেবক করতার ॥
তনের অন্তরে মন মনাস্তরে জ্যোতি।
জ্যোতির অন্তরে ধ্বনি উঠে প্রতিনিতি।
অনাহেতু শব্দ কহে সে ধ্বনির নাম।
সে ধ্বনির তত্ত্ব হন্তে সিদ্ধি মনস্কাম ॥
এখানকার এই অনাহত ধ্বনি থেকে জ্যোতি, জ্যোতি থেকে মন এবং মন থেকে তনুর উৎপত্তির ভিতরে বহু মুসলমান বিশ্বাসের সঙ্গে হিন্দুর শব্দ-ব্রহ্মের তত্ত্বটি এমনভাবে জড়িত হয়ে গেছে যে কাউকেই আর স্পষ্টরূপে চেনা যায় না। অথচ এখানকার তত্ত্বটি একটি নিজস্ব রূপ লাভ করেছে।
এই অনাহতে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য যে উল্টা-যােগের কথা বলা হয়েছে, সেই উল্টা-সাধন ভারতীয় সাধনারই একটি বৈশিষ্ট্য। এ-বিষয়ে আমি স্থানান্তরে বিশদভাবে আলােচনা করেছি। এই যােগসাধনাকে অবলম্বন করেই এসেছে গুরুবাদ তার সঙ্গে যুক্ত সূফী মুরশেদের তত্ত্ব।
এই ভাবেই বাঙালির সাধনায় ও সংস্কৃতিতে এসেছিল সহজ-সমন্বয়ের একতান। জাতীয় জীবনের সেই সত্যকে অস্বীকার করতে যাওয়ার অর্থ জাতীয় জীবনের স্বাভাবিক পরিণতিতেই বাধা দান। তাতে হয়ত সাময়িক অল্প-কিছু লাভ হতে পারে একটি বিশেষ শ্রেণীর––কিন্তু তাতে অনেকখানি লােকসান হবে সমগ্র জাতির।
শশীভূষণ দাশগুপ্ত (১৯১১-১৯৬৪) বাংলা দর্শন ও সাহিত্যের খ্যাতিমান গবেষক ।
সুত্র: শশীভূষণ দাশগুপ্ত, বাঙলা সাহিত্যের পটভূমিরুপে কয়েকটি ধর্মসাধনা , ভারবি ( ২য় প্রকাশ) ২০১১, কলকাতা।