ফররুখ ভাই

পটুয়া কামরুল হাসান

আজ কবি ফররুখ আহমদ নেই। প্রায় সকলের চক্ষুর অন্তরালে থেকেই তিনি চির অমরত্বের লীলাভূমিতে চলে গেলেন, চলে গেলেন বিনা নোটিশে বলা চলে। কবি ফররখ আহমদ বাংলাদেশের সাহিত্যক জগতে যেমন ছিলেন একক এবং অদ্বিতীয় তেমনি ছিলেন বিতর্কের উজানে শক্ত পেশীবহুল বৈঠা মেরে নৌকা বেয়ে নিয়ে যাওয়ার নাইয়া।

ফররুখ আহমদ-এর সাহিত্য আলোচনা বা তাঁর বিতর্কিত আদর্শ দর্শনের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা আমার উপপাদ্য নয়।

আমার লেখার বিষয় যে ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি কবি ফররুখ আহমদ নয়। আমার ফররুখ ভাই। এখানে আমার বলার পিছনে কারণ আছে, কারণ ফররুখ আহমদ তাঁর অনুজ সকলের কাছেই ফররুখ ভাই ছিলেন কিন্তু তা সাহিত্যিক শিল্পী সমাজের মাঝের মানুষদের।

কিন্তু কবি ফররুখ আহমদ যখন থেকে আমার ফররুখ ভাই তখন তিনিও কবি খ্যাতি লাভ করেননি। কেবল খ্যাতি লাভ করাই নয় বরং তাঁর লেখায় মকস চলছে। এবং আমিও তখন শিল্পী খ্যাতি লাভ তো দূরের ক্লাসে ড্রইং পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশী নাম্বার পাওয়ার প্রতিযোগিতার মাঝেই আমার বিচরণ ক্ষেত্র। এমনি সময় এবং বয়সেই আমি পেয়েছিলাম ফররুখ ভাইকে। সে ১৯৩০ সালের কথা আমি তখন শিশু ক্লাসে ভর্তি হলাম যে স্কুলে সেটি সে সময়ের বাংলাদেশের অন্যতম এম-ই স্কুলের মধ্যে একটি। কলকাতার তালতলা এলাকার ইউরোপীয়ান এ্যাসাইলাম লেন-এ এই স্কুল অবস্থিত ছিল, মডেল এম-ই স্কুল নামে এক ডাকে সকলেই জানতো, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মডেল স্কুল স্কীম এর সেটাই ছিল শেষ সরকারী স্কুল।

বিরাট এক পুরাতন জমীদার বাড়ি নিয়ে এই স্কুল। একই বাড়িতেই ছিল নর্মাল ট্রেনিং স্কুল । নর্মাল ট্রেনিং-এ যারা আসতেন, তারা তিন বছরের জন্য আসতেন এবং তারা বোর্ডিং থাকতেন এবং বোর্ডিংও ছিল ঐ একই বাড়িতে তাও হিন্দু এবং মুসলমান ছাত্রদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। তার মধ্যেই ফুটবল ও বাস্কেটবল খেলার মাঠ এবং তা পুরো সিমেন্ট এর।

নর্মাল ট্রেনিং-এর শিক্ষার্থীরা যেহেতু স্কুল সংলগ্ন বোর্ডিং-এ থাকতেন এবং যেহেতু, তারা মাঝে মাঝে তাদের প্র্যাকটিস টিচিং-এ আমাদেরকে পড়াতেন সেহেতু আমরা তাঁদেরকে বলতাম বোর্ডিং স্যার । সোজা হিসাব আর কি যারা পড়াবেন তাঁদের স্যার বলতে হবে অতএব তাঁরা বোর্ডিং-এ থেকে পড়াতে আসেন অতএব তারা হয়ে গেলেন বোর্ডিং স্যার। | কবি ফররুখ আহমদ-এর ব্যক্তিগত সম্পর্কে যখন থেকে এসেছি তখনকার কথা বলতে গেলে এই মডেল এম-ই স্কুলের কথা বলা আমার কেবল ইতিহাস রচনা বা কেবল স্মৃতিচারণই নয় বরং ফররুখ ভাই আমার সাথে দেখা হলেই মডেল স্কুলের গল্প করতেন এবং সে যে কি অভিব্যক্তি অনুভূতি এবং হদয়ের কি আবেগ নিয়ে বলতেন তা ভাষায় প্রকাশ করা আজ সম্ভব নয় তবুও আমাকে লিখতে হচেছ এই জন্য যে ফররুখ ভাই বার বার আমাকে বলতেন মডেল স্কুল নিয়ে লেখ, অমন স্কুল আর হয় না। তাই তাঁর আদেশ পালন করছি।

রবীন্দ্রনাথ একটিই স্কুলে ছেলেবেলায় কয়েক দিনের জন্য গিয়েছিলেন এবং ঐ মডেল স্কুলেই একথা আমরা জানতে পারি ঐ স্কুলে ক্লাসে কাঠের গ্যালারি ছিল, স্লোপিং গ্যালারি। একবার কথা উঠেছিল সরকারি ঐ গ্যালারীটি নীলাম করে দিবেন। তার প্রতিবাদ প্রচারেই আমরা জানতে পারি এই গ্যালারীতে বসে যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ছেলে বেলায পা ঝুলিয়ে এবং দুলিয়ে বসে বসে পড়ে গেছেন এবং এখানে বসেই বোধহয় তাঁর প্রথম কবিতা লেখা । এটা আমার অবশ্য তখন শিক্ষকদের কাছে শোনা সত্যাসত্য জানি না তবে রবীন্দ্রনাথ যে ঐ স্কুল এর ছাত্র ছিলেন এবং ঐ গ্যালারীতে বসে গিয়েছিলেন এ বিষয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ ছিল না কারণ তখনকার মত সেই গ্যালারী আর নীলাম হয় নাই।

মরহুম এটিএম মুস্তফা, জনাব আবুল খায়ের প্রাক্তন সচিব বাংলাদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প বিভাগের বর্তমান যুগ্ম সচিব জনাব নুরুজ্জামান , কবি হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডাইরেক্টর ড: নাজিমুদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের কবীর সাহেব, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার, খুলনা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ জনাব আবুল হাশেম প্রমুখ — এরা সকলেই সেই মডেল এম ই স্কুলের ছাত্র। আমার বড় ভাই জনাব আবুল হাসনাৎ প্রথমেই ঐ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন প্রায় চার বছর পূর্বে। আমি ঢুকলাম ১৯৩১ সালে সে সময কে জি ক্লাস বলে কিছু ছিল না। তার জায়গায় বলা হত ইনফ্যান্ট ক্লাস। সেই বাচ্চা বয়সে সাথী হিসেবে পেলাম ফররুখ ভাইয়ের ছোট মুনির আহমদকে। সে আর একটি চরিত্র। শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ চরিত্রের জীবন্ত সংস্করণ। ফররুখ ভাইয়ের মতই এক রোখা, তবে লেখাপড়া কিছুই করেনি ঐ মডেল স্কুল পর্যন্তই ইতি। কিন্তু কেন জানি না আমার সঙ্গ সে ছাড়েনি। কলকাতার আর্ট স্কুলেও আমার পিছু পিছু এক বছর পরে ভর্তি হয়েছিলেন। মাত্র এক বছরই ছিল।

পরবর্তীকালে ঢাকা কলাভবনে মডেল হিসাবে বহুদিন লাইফ ক্লাসে সিটিং দিয়েছিল। মুনির আমার সহপাঠী এবং আমার বড় ভাই ফররুখ ভাইয়ের স্কুল সহপাঠী অতএব খুব সোজা পথেই অগ্রজ এবং অনুজের সম্পর্ক গড়ে উঠলাে। আমাদের স্কুলের বকুলতলায় আমি আর মুনির গুলি খেলছি ফররুখ ভাই এসে বললেন কিরে তুই নাকি হাসনাতের ভাই, মুখ তুলে বললাম হ্যাঁ। সেই থেকেই ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত তুই সন্বোধনেই স্নেহের ডাক দিয়ে গেছেন। ফররুখ ভাইরা তিন ভাই ছিলেন, তাঁর বড়ভাই সিদ্দিক আহমদ। তিনি আজও ফরিদপুরে বসবাস করছেন। সিদ্দিক ভাইয়েরই ছেলে শহীদ সুফী। মোনেম বিরোধি আন্দোলনে ১৯৬৭ সালেহ সে নিহত হয় তার স্মৃতি স্তম্ভ আজ ফরিদপুর শহরে রয়েছে। ফররুখ ভাই ছিলেন ইসলাম এবং শরিয়তের গোড়া অনুসারি এবং তা এতো গোড়া এবং অন্ধ যে তা আমৃত্যু তিনি তাকে যুক্তি – তর্কের বাইরেই রেখে গেলেন। তিনি পাকিস্তানী আদর্শের একজন পর্বত কঠিন স্তম্ভ কিন্তু তাও তাঁর আপন দর্শনে রচিত পর্বত যে পর্বতের ধারেকাছে পাকিস্তানের কোন জাদরেল শাসকই ঘেঁসতে পারেনি।

আপন বিবেকের দিকে দৃষ্টি রেখে বলতেই হবে আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তান আমলের বহু কিছু আমরা মেনে নিয়ে ছিলাম, আমরা যারা ১৯৭১ সালের সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাম তাদের বহুসংখ্যক মহারথীই বহুবার পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে ঘুরে এসেছিলাম কিন্ত, নীতির যুদ্ধে যে লোকটিকে আমরা চিরকাল শত্রুশিবিরের লোক বলেই চিহ্নিত করে এলাম সেই ফররুখ ভাইকে গত তেইশ বছরে পাকিস্তান একটি দিনের জন্যও পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারেনি। এটা আপনাদের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাস্তব ঘটনা এবং পর্বত শিখৱের মতই—এমনি নিজের একান্ত নিজের মতবাদে অটল ছিলেন ফররুখ ভাই।

পরম বেদনা এবং অসহনীয় যন্ত্রণার ব্যাপার এই বাংলাদেশের এতবড় একজন আদর্শের পর্বত বাংলার সাধারণ মানুষের চোখের আড়াল করে রেখেছিল ফররুখ ভাইয়ের ধর্ম এবং শরিয়ৎ। পাকা সেগুন কাঠকেও যেমন ভিতরে ভিতরে উইয়ে কেটে দেয় ফররুখ ভাইকেও তেমনি তার ধর্মান্ধতার উই-এ খেয়ে শেষ করে ফেলল। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। অকস্মাৎ ঘর ভেঙে পড়লে দেখা যায় সকলের অলক্ষ্যে ঘরের খুঁটিতে উই-এর বাসা বেঁধেছিলো, ফররুখ ভাই যেন ঠিক তেমনি ভাবেই আমাদের সামনে থেকেই ভেঙ্গে পড়লেন। তাঁর মৃত্যুর মাত্র আধ ঘন্টা আগে আমি তাঁর ফ্ল্যাটের নীচের ফ্ল্যাটে গায়ক আবদুর লতিফের বাসায় গিয়ে শুনলাম আজ চারদিন ফরুরখ ভাই এর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। আমি প্রায় প্রতিদিনই লতিফের বাসায় একজন আড্ডাধারী মানুষ , লতিফের স্ত্রী আমার মামাতো বোন সেই সুবাদেই ফররুখ ভাইয়েরও যে বোন এবং লতিফ আমারই মত অগ্রজ [অনুজ] প্রতিম। লতিফ তখন শিল্পী হয়ে গিয়েছিলো। আশ্চর্য আমি কাজের ব্যস্ততার জন্য গত এক সপ্তাহ লতিফের বাসায় যেতে পারিনি। লতিফের স্ত্রী আমাকে একবার অনুরোধ করল ফরুরখ ভাইকে দেখতে যাওয়ার জন্য। খুব চিন্তায় পড়লাম। আমি ফররুখ ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, তিনি আমাকে দেখতে পাবেন অথচ কথা বলতে পারবেন না, এ যন্ত্রণা তাঁর এবং আমার দুজনেরই।

বললাম, কাল সকালে অবস্থা বুঝে আসবো। বাড়ি ফিরে জামা-কাপড় ছেড়েছিমাত্র, লতিফের ছেলে এসে সংবাদ দিল । সেই সংবাদই রাত্রের বেতারে এবং টেলিভিশনে প্রচারিত হল, কবি ফররুখ আহমদ ইন্তেকাল করেছেন। আমাদের তথাকথিত আদর্শের বিপরীত তীরের বিরাট বটগাছটা গোড়া উপড়ে পড়ে গেল। ফররুখ ভাই তাঁর আদর্শ না একগুয়েমি জানি না, যার জন্য মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মানুষ হিসাবে সকলের ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই চলে গেলেন । অথচ ফররখ ভাই ছিলেন সত্যিকারের নিপীড়িত আদম সন্তানদেরই অতি আপনজন না হলে সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই একজন বৃটিশ সরকারের সনদ পাওয়া পুলিশ অফিসার এবং সৈয়দ-পুত্র নিজের নামের আগে সৈয়দ লেখা ত্যাগ করেছিলেন। কারও নির্দেশে নয়, কোন প্রভাবশালী নেতার ভয়েও নয় । হঠাৎ এক সময়ে আমরা দেখলাম ফররুখ ভাই আর সৈয়দ লেখেন না। প্রশ্ন করলাম একদিন। ফররুখ ভাই-এর ভাষাতেই বলি, তিনি উত্তর দিলেন, ‘অনেক ভেবে দেখলাম ও শালার সৈয়দের গুষ্ঠির মধ্যে থাকলে সত্যিকারের মানুষের গুষ্ঠির বাইরে থাকতে হবে আমাকে তোরা কি মনে করিস? ও শালার ফালতু ল্যাজটা কেটে বাদ দিয়ে দিলাম।

স্মৃতিচারণ মূলক লেখাটি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ১৯৭৪ সালে ছাপা হয়। 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply