১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা ছিলেন পাকিস্তান বাহিনীর জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। এই গেরিলা বাহিনীর অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন মাসুদ সাদেক চুল্লু। এই দুর্লভ সাক্ষাৎকারে তিনি ১৯৭১ সালে তাদের বিভিন্ন দু:সাহসিক অপারেশন, অত:পর পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার ও নির্যাতিত হওয়ার বিবরণ তুলে ধরেছেন।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ এর আগেই আমি ঢাকা চলে আসি। আমি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলাম না। কোম্পানি থেকে আমাকে পোস্টিং দিয়ে লাহোরে পাঠাতে চেয়েছিল। আমি রাজি হলাম না, ঢাকায় যেতে চাইলাম। তখন একজন বিদেশি ভদ্রলোক (আমেরিকান) আমাকে চীফ করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবার জন্য বললেন। আমি ইন-চার্জ হয়ে আসলাম। তখন ঢাকায় যিনি ইন-চার্জ ছিলেন, তিনি ঢাকার উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখে লন্ডন চলে গেলেন। তার জায়গায় আমাকে সেখানে পোস্টিং দেওয়া হলো। আমি ঢাকায় আসার পর অফিস সাজানোর জন্য একটি বাড়ি দেওয়া হলো। বাড়িটি ছিল দিলারা হাশেমের ধানমন্ডির ২৮ নম্বরে। অফিস সাজানো হলো।
বঙ্গবন্ধু যখন ৭ই মার্চ তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন, তখন আমরা অনেকেই গিয়েছি। আমার পরিচিতিজন যারা পলিটিক্স করতেন তারা যেখানে যেতেন, আমিও পরিস্থিতি বোঝার জন্য সেখানে যেতাম। ৭ মার্চের পর ক্র্যাকডাউন হল। ২৫শে মার্চ রাত, কারফিউ, সব বন্ধ। ২৭শে মার্চ কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ ভাঙ্গলো। আমার একজন খালা ছিলেন আজিমপুরে। আমার শ্রদ্ধেয় সাদেক ভাই যিনি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে, বললেন “চলো আমরা দেখে আসি আজিমপুরে খালা কেমন আছেন?” আওয়ামী লীগের সময়ে সাদেক ভাই শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। দেখলাম অনেক ডেড বডি পড়ে আছে। এদিক ওদিক, ছড়ানো ছিটানো। ভাই বললেন, “তুমি একদম মুখ বন্ধ রাখ, সব গাড়ি চেক করছে।” আমরা আজিমপুর পৌঁছালাম। আবার যখন ফিরে যাচ্ছি তখন পাক আর্মি জিজ্ঞাসা করছে, এই মাত্র গেলে, আবার কোথায় যাচ্ছ? বললাম, বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। জানতে চাইলো কোথায় গিয়েছিলাম? আমি একটু মেজাজ করে উত্তর দিলাম। তখন বললো, “শ্যুট কার দেগা।” একজন ক্যাপ্টেন জীপে বসেছিল। আমি আর কোন উত্তর দেই নাই। ভাই বললেন, “চুপ করো তুমি। বেশি কথা বলো।” বাসায় পৌঁছালাম। আমি গেলাম আমার আরেক খালার বাসায় ধানমন্ডি ৪ নম্বরে। ওখানে আমার কাজিনরা আসে। শাহীন আনাম আমার খালাতো বোন। ওদের ওখানে গিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকজন আছে, ওদের সাথে আলাপ করলাম। আমাদের কি করা উচিত এসব নিয়ে। তারা বলল সবাই গ্রামে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমার সঙ্গে একজনের দেখা হল যার নাম আমি এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। সে বলল, কেউ কেউ ওপারে চলে যাচ্ছে। খালেদ মোশাররফের নাম বলল। আমি কিছু বলি নাই। আমি ভাইকে এসে বললাম। ভাই বললেন, “সিচুয়েশান দেখে নাও। কে তোমাকে কি বলল, এটা ব্লাফ কিনা।” যাই হোক, আমি চুপচাপ থাকলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গেলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে গেলাম। দেখলাম অনেককে মেরে ফেলেছে।
এপ্রিল মাস এসে গেছে। যুদ্ধে জয়েন করার জন্যই আমি এপ্রিল মাসে কয়েকজনের সাথে চলে গেলাম ইন্ডিয়াতে ট্রেনিং নেয়ার জন্য। গিয়ে দেখলাম তখন অর্গানাইজড কিছু হয় নাই। কোথায় যাব? কি করব?
শুনেছিলাম ক্যাম্প হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিচ্ছে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম কিছু নাই। হয়ত হয়েছিল।আমি অত খোঁজ নেইনি। এর মধ্যে একজন খালেদ মোশাররফকে চিনত। উনাকে গিয়ে বলল যে কয়েকজন এসেছিল। আমার নামটাও বলল। উনি ভাইকে চিনতেন, আমাকে সেভাবে চিনতেন না।
যাই হোক, আমরা চলে এসেছি। আবার গেলাম ধানমন্ডির খালার বাসায়, শুনলাম ইতোমধ্যে কিছু আর্মস এসেছে। শহীদুল্লাহ খান বাদলরা নিয়ে এসেছে। তখন যা অবস্থা ছিল যে কারোর বাসায় কেউ যেত না। দুটোর পর মনে হতো শ্মশানঘাট। লোকজন নেই রাস্তায়। আমাদের যাদের গাড়ি ছিল তারা কিছুটা ঘুরে বেড়াতাম। এর মাঝে একটা ঘটনা ঘটল। আমি স্টেডিয়ামের দিকে গিয়েছিলাম পরিস্থিতি দেখার জন্য, দেখলাম লাশের স্তুপ পড়ে আছে। আর্মি আমাকে থামাল, দেখলাম আরো ২-৩ জনকে থামাল। থামিয়ে বলল, স্তুপ করা লাশগুলো ঠেলাগাড়িতে তোল। আমরা কয়েকজন মিলে লাশগুলো তুললাম। তারপর আমি বাজার করতে নিউমার্কেটের দিকে গেলাম। দেখলাম সব বন্ধ। কিন্তু মাংসের দোকানের ওখানে কতকগুলো বাক্স রাখা রয়েছে। লক্ষ করে দেখলাম বাক্স ফুঁটো। রক্তের লাইন নেমে এসেছে। বাক্সের পিছনে ২/৩টা লাশ রয়েছে। মানবিক কারণে লাশ দুটো বের করা দরকার। টেনে লাশ বের করলাম। এসময় ২-৪জন আর্মি আসল, জিজ্ঞাসা করল, কি করছ তোমরা ওখানে? বললাম, লাশ পড়ে আছে। ওরা বলল, তোমাদের কি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এটা? যাই হোক আমরা বোঝালাম। আরেকজন বলল, “ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়, লাও।” আমরা ট্রাকে তুলে দিলাম ৩টা কি ৪টা লাশ। আমার মাথা ঘুরতে লাগল। যেখানে সেখানে লাশ পড়ে রয়েছে। রিক্সার মধ্যে। যাই হোক, যখন শুনলাম আর্মস এসেছে, কোথায় রাখা যায়? তৌহিদ সামাদ ছিল আমাদের বন্ধু মানুষ। সে রোড নং- ৪ এ খালার বাসার অপজিটে থাকত। ও বললো ঠিক আছে আমার বাসায় নিয়ে যাও। থ্রি-নট-থ্রি আর কিছু বুলেট। বুলেট অনেকগুলো ছিল। ডানোর টিন ভর্তি। কিন্তু কে রাখবে? আমি বললাম আমি রাখব। তখনো কিন্তু ওইভাবে চেকপোষ্ট বসেনি। আমার বাসায় রাখলাম। ভাইয়ের সোফার নিচে কেটে রেখে আবার সোফা সিলাই করে দিলাম।
তারপর বাদলদের সঙ্গে আলাপ হল। আগে থেকেই চিনতাম বাদলদের সবাইকে। ঠিক করলাম গেরিলা অ্যাটাক করব।
খালেদ মোশাররফ বলেছেন হায়দার ভাই কমান্ডো ট্রেনিং মানে গেরিলা ট্রেনিং দিচ্ছেন। গেরিলাদের কাজ ছিল সবসময় পাক আর্মিকে ডিস্টার্ব করা। কিছু না, একটা গ্রেনেড মারো, এখানে মারো ওখানে মারো। ওদের ঘুম হারাম করে দেয়া আর কি! ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অপারেশনে অল্প কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিল। প্রত্যেকের নাম না বললে ভুল হবে। জিয়া, আলম, মায়া এই তিনজনের কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। আমরা ২টা গাড়ি যোগাড় করলাম। একটা গাড়ি থেকে গ্রেনেড মারবে, আরেকটা গাড়ি যদি তাদেরকে পাক আর্মি চেস করে তবে প্রোটেকশন দিবে। আমরা ফুটপাতের একপাশে বসে। ওরা কয়েকজন ভেতরে ঢুকে গ্রেনেড ফুটাল। ফুটায়ে ওরা বেড়িয়ে চলে গেল। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম দেখার জন্য কেউ চেস করে কিনা। করলে আমরা বাধা দেবার চেষ্টা করব। যদিও মেশিনগানের বিরুদ্ধে তেমন বাধা দিতে পারব না, কিন্তু এমন বাধা দিব যাতে ওরা বেরিয়ে যেতে পারে। এরপর যা হবার হবে। ওরা বেরিয়ে গেছে, আমরা উল্টো পথে চলে এলাম। নিরিবিলি একটা জায়গায়। গোলাম আযম থাকত রমনা থানার পেছনে একটা গলিতে। ওরা করল কি ঘুরে গোলাম আযমের বাসায় গেল। গলির মধ্যে ১টা না ২টা গ্রেনেড মেরে বেড়িয়ে চলে গেল। যতদূর আমার মনে পড়ে ঢাকা শহরে এটা আমাদের প্রথম অপারেশন। পরে ভেবে দেখলাম, এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে হবে না। আমাদের অর্গানাইজড হতে হবে। মায়ারা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসল। আমার কিছু ট্রেনিং ছিল এন.সি.সি থেকে। এন.সি.সি ইউনিভার্সিটির ছেলেদেরকে ট্রেনিং দিত আর্মস চালানোতে। আমি গিয়েছিলাম ভারতে। গ্রেনেড মারা সহ বিভিন্ন কিছু দেখে আসলাম। আমাদের গেরিলাদের ওই ধরনের ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন হয় নাই। কারণ প্রত্যেকেই কিছু না কিছু জানতাম – একটা গ্রেনেড কিভাবে খুলতে হয়? গ্রেনেড কয় সেকেন্ডে ছুঁড়তে হয় এগুলো মৌখিকভাবে সবাই জেনে ফেলেছে। মেলাঘরে কাউকে স্পেশাল গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হয় নাই। সবাইকে একই রকম ট্রেনিং দেয়া হয়।
খালি সাহসী ছেলেদের খালেদ মোশাররফ ঢাকার জন্য নির্বাচিত করেন যারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাবে না। আমাদের কয়েকজনের ভাব জানতেন উনি। এর জন্য ক্র্যাক প্লাটুন নাম দিয়েছিলেন; বলেছিলেন যে এরা ব্যাটল ফিল্ড ছেড়ে পালাবে না। আমাদের গ্রুপে ১৪-১৭জন ছিল। আমার বয়স তখন ২৪, শাহাদত ভাই আমার চেয়ে ২ বছরের বড় ছিলেন। এখন কথা হচ্ছে অপারেশনটা হবে কিভাবে? গাড়ি প্রয়োজন। আমি বললাম আমার গাড়ি আছে। কোম্পানি আমাকে গাড়ি দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এসে থাকবে কোথায়? আমি বললাম ২৮ নম্বরে থাকবে। কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করে তবে বলব এরা সবাই অফিসে চাকরি করে। প্রত্যেকের আইডি কার্ড বানিয়ে দিলাম। বিরাট করে কোম্পানির এক সাইনবোর্ড লিখে দিলাম। ইউএসএ লেখা থাকাতে ওরা কোনদিন চিন্তা করেনি এর ভেতরে কি হচ্ছে? আর্মস আনতাম, ওখানে রাখতাম, আমার ভাইয়ের বাসায় রাখতাম, খালার বাসায় রাখতাম।

তারিখ আমার মনে নাই। সে সময় আমরা ঠিক করলাম পাওয়ার স্টেশন উড়াব। বিগেস্ট অপারেশন আমি বলব। ঢাকায় পাওয়ার স্টেশন আর সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন। গাজী গোলাম দস্তগীর যিনি এখন এমপি, গাজী ট্যাংকের মালিক, উলনে তাদের পাওয়ার স্টেশন অপারেশন সাকসেসফুল হল। আরেকটা হাফ-সাকসেসফুল হল। মালিবাগে একটা পাওয়ার স্টেশন ছিল, সেটার জন্য আরেকটা গ্রুপ গিয়েছিল। তারা হাফ-ডান করেছিল। কিছুটা উড়াতে পেরেছে। আমাদের গ্রুপে আমি, জিয়া আর শহীদ বলে আরেকটা ছেলে ছিল। হ্যারিস ছিল আরেকটা গ্রুপে যেটা গিয়েছিল এলিফ্যান্ট রোডে। সেটাও সাকসেসফুল হয় নাই কারণ স্বপন আগেই গুলি করে বসেছে। আনু আর মায়ারা ছিল মতিঝিলে কালি মন্দিরের ওখানে কোন একটা পাওয়ার ষ্টেশনে। আমার নিজের গাড়ি ১টা; আর দুটো গাড়ি হাইজ্যাক করেছি। তখন গাড়ি হাইজ্যাক শুরু হল। স্বপন আর আরেকজন আদমজির একটা গাড়ি হাইজ্যাক করেছে খুব সহজে। ড্রাইভার কাকে যেন বলল যে আমিতো আপনাকে চিনতে পেরেছি। তেজগাঁও থেকে যে রোডটা বাইপাস হয়ে গুলশানের দিকে গেছে আগে সেখানে দুইদিকে পানি। মাঝখানে কোনমতে একটা রাস্তা ছিল। আদমজির ড্রাইভারসহ সেখানে গিয়ে ড্রাইভারকে বলল, “তুমি নেমে যাও, আমরা গাড়ি ঘুরাব।” ড্রাইভার বলল, “স্যার আমিতো চাকুরি করি, আপনি গাড়ি নিচ্ছেন। আমার তো চাকরি চলে যাবে।” আমরা বললাম চুপ কোন কথা বলবা না। তখন স্বপন অথবা অন্য কেউ ড্রাইভারের মাথায় গুলি করে পানিতে ফেলে দিল। কারণ সে একজনকে চিনে ফেলেছে, সে বলে দিবে। লেকের পাশে ডেডবডিটা ফেলে গাড়িটা নিয়ে চলে এসেছে। এসে রাখল ২৮ নম্বরে। আমরা সব লুকাই যে যার মত। তখন অপারেশন ঠিক হল এত তারিখ রাতে, এতটার সময় আমরা সব এক সাথে হব। তখন মায়া বলল যে এখান থেকে সব গাড়ি যদি একসাথে কেউ বের হতে দেখে তাহলে সন্দেহ করবে। যার যার এলাকার আশেপাশে রাখতে হবে। আমার এখান থেকে দুটো গাড়ি বেরিয়েছিল, একটি এলিফ্যান্ট রোডে অন্যটি তেজগাঁও রোডে যাবে। বাকী গুলো যার যার জায়গায়। আমরা গেলাম অপারেশনে। আমাদের ঠিক ছিল যে, ঠিক এত মিনিট, এত সেকেন্ডে আমরা একসঙ্গে অ্যাকশনে যাব। আমি আর জিয়া যেই পাওয়ার স্টেশনটায় গেলাম সেখানে একবার ঢুকলে কিন্তু আর কোন পথ নাই। আবার ওখান থেকে প্রায় ১/২ কিলোমিটার গাড়ি ব্যাক করে ফিরতে হবে।
যদি আমরা আনসাকসেসফুল হই তাহলে আমাদের বাঁচার কোন চান্স নাই। আনসাকসেসফুল হলাম, কিন্তু আমাদের তার আগে রেকি করা হয়েছিল। রেকি রিপোর্ট থেকে জানা গেল যে, গার্ড থাকে, কোন আর্মি গার্ড না, তিন চারজন থাকে, তাদের কাছে কোন আর্মস ছিল না কিনা জানি না। যা আছে ও আমরা কাবু করতে পারব। আর বাকি সব জায়গাতে একই অবস্থা জ্জ জন। এটা রটে গেল বোধহয় আর্মির মধ্যে, ইন্টেলিজেন্সে খবর হয়ে গেল। আর্মি চেকপোস্ট বাড়িয়ে দিল, একেক জায়গায় ৩ জন ৪ জন করে বসিয়ে দিল। আমরা সেটা লক্ষ করিনি। আমরা গাড়ি নিয়ে চলে গেছি ভেতরে। স্বপনরা এলিফ্যান্ট রোডে চলে গেছে। উলনে গাজী বিহারী ভাষা-টাষা বলে ভিতরে ঢুকে গেছে। ওদের গ্রুপে আর কে ছিল মনে করতে পারছি না। আমি আর জিয়া গেলাম। গেটের কাছে লাইট পড়াতে উপর থেকে চিৎকার করল, হল্ট। আমরা দেখলাম গার্ড উপরেও। স্টেনগান বসানো। আমরা কি করব এখন? গাড়িকে ব্যাক করাতে হবে। লাইট বন্ধ করে দিলাম। কারণ যদি লাইট থাকে তাহলে লাইট দেখে গুলি করবে। লাইট বন্ধ করে জিয়া ফায়ার আরম্ভ করল। আর আমি গাড়ি চালাচ্ছি। ব্যাক করছি। কিন্তু কত স্পিডে বলতে পারিনা। সোজা বেরিয়ে মেইন রোডে আসলাম। জিয়া তখনও ফায়ার করছে। ফায়ার করতে করতে চলে এসেছি। পথে এসে লাইট জ্বালালাম। দেখলাম বেশ কয়েকজন বেরিয়েছে, প্রায় ৮/৯ জন। আমরা জানতাম ৩ জন করে থাকে কিন্তু দেখা গেল ৮-৯ জন করে আছে। আমরা পালিয়ে ২৮ নম্বর রোডে চলে গেছি। ওখানে এলিফ্যান্ট রোডে স্বপন এক্সপ্লোসিভ নিয়ে নামবে। সে সেটা নিয়ে নেমেছেও। স্বপন খুব সাহসী ছেলে আমি বলব। আনু এক্সপ্লোসিভ নিয়ে আর স্বপন তার পিছনে পিছনে স্টেনগান নিয়ে ভিতরে ঢুকেছে। উপর থেকে ফায়ার করা হয়েছে। স্বপনের গুলি লেগেছে। স্বপন তখনও ধামধাম করে গুলি করছে। আনোয়ার এক্সপ্লোসিভ লাগাতে পারেনি কারণ তখনত অলরেডি আর্মি নেমে গেছে। সেটা ফেলে দিয়ে আনু দৌড় দিল, এটাই স্বাভাবিক।
এত গোলাগুলির মধ্যে লাগানো যায় না। ওরাও পালিয়ে গেল। শুধু উলন আর মালিবাগ। মালিবাগটা পার্শিয়াল কিন্তু উলন পুরোটা উড়িয়ে দিয়েছিল গাজী। তারপর আমরা আবার পালিয়ে চলে আসলাম, আসার পর আমরা ঠিক করলাম এরপর ছোটখাট অপারেশন করতে হবে। যেমন বোমা মেরে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া। আর আমাদের যত অ্যাটাক হত সব সন্ধ্যাবেলা কারণ তখন রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। এমনি লোকজন কম ছিল। রাস্তাঘাটে রিক্সা নাই, গাড়ি চালাতে আরাম। আমরা ঠিক করলাম ছোটখাট অপারেশন করব। গেনিজ নামে একটা কাপড়ের দোকান ছিল। পাঞ্জাবিরা শপিং করতে যেত। মায়া আমাকে বলল যে আমরা গাড়িতে না যেয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে ভিতরে গ্রেনেড মেরে চলে আসব। তোমরা ফায়ার করবা। গাড়ি ব্যাকআপ দেবে। গ্রেনেডটা ভেতরে ছুঁড়বে গাজী আর মায়া। গাজী ছুঁড়বে মায়া চালাবে অথবা গাজী চালাবে মায়া ছুঁড়বে। যে কোন একজন। গ্রেনেডটা দোকানের ভিতর ফেলা হল আর আমাদের বলা হল ফায়ার করতে। ওরা বেরিয়ে গেছে। দুটো গ্রেনেড ফাটার সঙ্গে সঙ্গে ওখানে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমরা বললাম ফায়ার করে লাভ কি? পুরো আগুনই ধরে গেছে। আমরা সচিবালয়ের সামনে দিয়ে পালিয়ে চলে আসলাম।
রুমীকে আগে থেকেই চিনতাম। পরিচয় ছিল কিন্তু এত ক্লোজ ছিল না। জাহানারা ইমামকে সবাই চিনত। তিনি সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন। উনার ছেলে। কোন রকম অহংকার নেই। তার আগে তাকে আমি আমার খালাতো বোন শাহীন আনামের বাসায় দেখেছিলাম একবার, দুবার। দেখা হলে হাত মিলানো।এই আর কি। হঠাৎ শাহাদত চৌধুরী একদিন আমাকে বলল, “চল এক জায়গায় যাই। কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে তুমি? আমার গাড়িতে করে আমরা গেলাম চাচীর (জাহানারা ইমাম) বাসায়। গেলাম। চাচী দরজা খুললেন। বললাম, “রুমীকে তো শাহীনের বাসায় দেখেছি। ওখানে গিয়ে শুনলাম রুমী ট্রেনিং না নিয়ে ফেরত এসেছে। সে অন্য পথে গিয়েছিল যেখানে আর্মি ব্লক করা আছে। ফিরে এসে আবার অন্য পথে গেল। বোধহয় কুমিল্লা, দেবীদ্বার ঘুরে সে গেছে আবার। রুমী তখন ট্রেনিং নিয়ে চলে এসেছে। আরম্ভ হল আমাদের যুদ্ধ। অপারেশনে যাই এক একটা গ্রুপে।
ফার্মগেট অ্যাটাক হবে। আমি আর জিয়া আরেকটা গাড়িতে স্টেনগান নিয়ে অপজিট ডিরেকশনে আছি। যদি আর্মি চেস করে আমরা প্রোটেশন দিব। ওরা অ্যাটাকে ফেল করলে ওদেরকে চেস করবে নিশ্চয়ই। আমরা অপজিট ডিরেকশন থেকে আর্মিকে ফায়ার করে থামাব যাতে ওরা পালায় যায়। ওখানে দারুল কাবাব নামে একটি বিখ্যাত কাবাব ঘর ছিল। পাঞ্জাবী আর্মিরা এসে খাওয়া দাওয়া করত। আমরা তাদেরকে পার হয়ে একটা গাড়িতে Ñ আমি, জিয়া, আনু (আনোয়ার রহমান)। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। ওরা স্টেনগান নিয়ে গাড়িতে বসে আছে অপজিট ডিরেকশনে। ওরা হলিক্রসের ওখান থেকে বেড়িয়ে স্ট্রেইট মেইন রাস্তা দিয়ে যাবে, আমরা অপজিট ডিরেকশনে, যদি কেউ চেস করে তাহলে আমরা ফায়ার আরম্ভ করব। দেখলাম ওরা অন্য পথে বেরিয়ে চলে গেছে। আমরা তখন মুসিবতে। আমাদের এখন যেতে হলে ওদের মাথার উপর দিয়ে যেতে হবে যেখানে অ্যাটাকটা হয়ে গেছে অলরেডি। আমরা ঐ রাস্তায় গাড়ির মুখটা ঘোরালাম। তখন আর কোন পথ নেই। তখনত তেজগাঁও এয়ারপোর্ট হল মেইন এয়ারপোর্ট। তখন আমরা ওখান থেকে ফেরত আসলাম ঘুরিয়ে। ২৮ নম্বরে গেলাম। দেখলাম ওরা ঘুরে ২৮ নম্বরে আসল। এসে বলল, সাকসেসফুল। সে গাড়িতে আলম, বদি,স্বপন, মায়া, পুলু ছিল। জুয়েল আমার সঙ্গে ছিল। যাইহোক, আমরা বসলাম, আর্মস নিয়ে কি করা? বিল্ডিংটা খুব মজার ছিল। ছোট ছোট পিলারের উপর বিল্ডিং ছিল। বাড়ির ওখানে একটা গর্ত ছিল তার ভেতরে আর্মসগুলো রেখে দিলাম। ঘাস ছিল, কেউ যদি দেখতে চায়, টর্চ মারলেও দেখতে পারবে না। আর কিছু গ্রেনেড আমার গাড়িতে ছিল। সেগুলো আমি আমার ভাইয়ের বাসায় (সাদেক সাহেবের) রেখে দিলাম। সোফার নীচে রেখে আবার সিলাই করে দিলাম। স্বপন ওই গাড়িতেই ছিল। তারপর ধানমন্ডিতে একটা অপারেশন হল।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল।
আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল মুক্তার নামে। খুব সাহস ছিল। নাম করা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তারের ছোট ভাইটা বন্দুক পরিষ্কার করছিল। পরিষ্কার করতে গিয়ে বুলেট শরীরের ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। গুলি লেগেছে, ওকে তো বাঁচাতে হবে। রাতে শাহাদত চৌধুরী আর কে ছিল আমি জানি না। তারা তাকে স্কুটারে করে নিয়ে ২৮ নম্বরে চলে এসেছে যেটাকে রেসিডেন্সিয়াল অফিস বলি। বিরাট করে সাইন বোর্ড লাগানো। চৎড়ঢ়বৎঃু ড়ভ টঝঅ। আর্মি জীপ, ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা গেলে দেখত চৎড়ঢ়বৎঃু ড়ভ টঝঅ । আর একটা কোম্পানির নাম বিরাট করে লেখা। আমেরিকানদের তো আর খেপানো যাবে না। তারা সন্দেহ করতে পারেনি যে এর মধ্যে কি। আর ঐ গুলি লাগা ছেলেটাকে নিয়ে চলে এসেছে আমার ২৮ নম্বরে। এখন কিভাবে তাকে ট্রীটম্যান্ট করব? চাচীর (জাহানারা ইমাম) বাসার পাশেই পলি ক্লিনিকের ডাক্তার আজিজ থাকতেন। উনাকে খবর দেয়া হল। এটা শাহাদত ভাই জানত যে চাচীদের সঙ্গে উনার ভালো সম্পর্ক আছে। তখন রাতেও কিন্তু গাড়ি চলে। সাহস যাদের আছে তারাই বের করে, আর কেউ বের করত না ভয়ে। অফিস থেকে আসার পর লোকেরা ভেতরে ঢুকে দরজা যে বন্ধ করত খুলত পরদিন সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার সময়। বাইরে বাতি জ্বালাত না, ভিতরে বাতি জ্বালিয়ে খাওয়া দাওয়া। মানে এত ভয়! আমরা যখন বের হতাম রাতে সবাই বলতো যে কি ব্যাপার রাতে?
আমি বাসা চেঞ্জ করতাম। একবার ভাইয়ের বাসায় থাকতাম। আর একবার অফিসের বাসায় থাকতাম। অফিসে খাট ছিল, সব ছিল। আমার ভাই সাহস যোগাতেন আমাকে আর রুমীকে। আমি আর রুমী উনার খুবই ভক্ত ছিলাম। উনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। পাকিস্তান আমলে ঈঝচ ঙভভরপবৎ বাংলাদেশে একটি বিরাট পোস্ট। তখন তিনি ঘধঃরড়হধষ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ চঁনষরপ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ এর উরৎবপঃড়ৎ। সব এড়াবৎহসবহঃ ঙভভরপবৎ এর ঞৎধরহরহম ওখানে হত। উনি ওখানকার উরৎবপঃড়ৎ। উনার বাসায় আমি থাকতাম। একদিন আর্মস নিয়ে আমি আর রুমী উনার বাসায় গেলাম। ২টা স্টেনগান নিয়ে কোথায় রাখব? ভাই দেখে বললেন, “বড় ভারী জিনিস তো! তোমরা চুপচাপ থাক, আমি রেখে দিচ্ছি।” উনি অস্ত্র দুইটিকে উনার সুটের ভিতর দাঁড় করালেন। বললেন, “দেখ আমি কোন সময় না থাকলে এখানে রেখে দিতে পার। স্যুট আর শেরওয়ানীর ভিতর ঢুকিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আলমারি খুললে কি দেখবে, স্যুট আর শেরওয়ানী। হঠাৎ করে বুঝতে পারবেনা। আর হঠাৎ করে তো কোন বাড়ি সার্চ করতে পারে না। এত বড় অফিসার আর আশেপাশে সব সচিব তখনকার। রমনা থানার অপজিটে আদমজি বিল্ডিংয়ের দেওয়ালের সঙ্গে লাগান উনাদের সব ১নং, ২নং, ৩নং। ১নং টেনামেন্ট হাউসে ছির উনার বাসা।
আমি আর রুমী সবসময় যখনই একটু ফুরসত থাকত, অপারেশন নাই, পড়তাম। রুমী সবসময় কিছু না কিছু অ্যাকশন করতে চাইত। বলত চলো আমরা দুজনে মিলে করি। আমি বলতাম আচ্ছা করবা তো একটা প্লান কর কোথায় করবা? রুমীর জবাব চলো রমনা থানায় একটা গ্রেনেড মেরে আসি। আমি ঠাট্টা করে বলতাম তারপর এসে তো এখানে ঢুকবা, ওরাতো দেখবে কোথায় ঢুকছ। রুমী বলত চলো আমরা গাড়িতে করে, আমার হাতে গ্রেনেড থাকবে, গ্রেনেড লক করে দিয়ে গাড়ি ঘুরায়ে নিয়ে পালায় চলে আসব। আমি ভাল গাড়ি চালাতে পারতাম। রুমীর প্রিয় ছিল গান শোনা। আমার কাছে প্রচুর রেকর্ড ছিল। ও নিত, শুনতো। ভাই অফিস থেকে এসে আমাদের গল্প শুনতেন, “কি অপারেশন করবা? কখন করবা?” আমরা বলতাম। ভাই বলতেন, “দেখ, এটা কোন স্টেডিয়ামে খেলা না, খুব সাবধান, নিজেকে বাঁচায় যতদিন করতে পার। এটা চলবে কারণ যুদ্ধ কখন শেষ হবে তুমি জান না। আমরা যুদ্ধে নেমে গেছি।”
ভাইয়ের এখানে আমাদের আর্মস রাখা, মুক্তিযোদ্ধারা আসত। আমি, আলম,শাহাদত চৌধুরী, বদি, রুমী। আমার একটা রুম ছিল। ভাইয়া দরজা খুলতেন আর বলতেন, “বলো আজকে তোমাদের কোথায় প্রোগ্রাম। আর্মস বের করেছ?” আরো বলতেন, “অপারেশন করে নিজেকে বাঁচায়ে রাখ। অন্তত এক গ্রুপ নিজেকে বাঁচায় রাখ। এক গ্রুপ যদি আল্লাহ না করুক মারা যায় তাহলে ঐ গ্রুপ অ্যাকশনে থাকবে।” খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধব দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যুদ্ধে না। চলে গেছে যে কোন কারণেই হোক। রুমীর সঙ্গে তখন আমার ক্লোজনেস আরম্ভ হল। যখনই রুমী সময় পেত চলে আসত গান শুনতে আর বই পড়তে। আর বদি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, মেধাবী, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনোমিকসের ছাত্র। সে আসত। ভাইয়ের প্রচুর বই ছিল, ভাই ইকোনোমিকসের ছাত্র ছিল। উনার বইগুলো নিয়ে বলত, “ভাই বইগুলো পড়ি?” ভাই বলতেন, “পড়ো।” আমার রুমটাই উনার লাইব্রেরি ছিল। বদি শুয়ে শুয়ে বই পড়ত। রাত হয়ে গেলে, ভাবী খাবার দিয়ে যেত আমাদেরকে, খেয়ে দেয়ে আমরা তিনজন এক রুমে গল্প করতে করতে ঘুমায় পড়তাম।
খালেদ মোশাররফের অর্ডার আসল যে যেভাবেই হোক খালেদ মোশাররফের বাচ্চা দুটোকে নিতে হবে। কোথায় বাচ্চা? খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। উনার বাসায় রাখা আছে। উনি থাকেন কোথায়? তখনতো সবকিছু বিক্ষিপ্ত। কে কোথায় থাকে? আমাদের মধ্যে একজনকে ঠিক করা হল স্কুল ছুটির সময় গেট থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রিন্সিপালতো বের হবেন তখন উনার পিছু নেবে। উনি বেরিয়ে প্রথমে ডানে বায়ে দেখছেন, কেউ দেখছে কিনা। দূওে দেয়ালের আড়ালে থেকে উনাকে লক্ষ্য করলে তো উনার বুঝতে পারার কথা না। উনি বড় বাচ্চাটাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে আসছেন। একজন সাইকেলে করে আস্তে আস্তে উনার পিছন পিছন আসছে, উনি ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছেন আবার। ঞঘঞ অফিসের উল্টো দিকে যে বিল্ডিং, তার তিন তলায় উঠে গেছেন বাচ্চা নিয়ে। রাস্তা থেকে তো নেয়া যাবে না। কি করা? আমি বললাম, ঠিক আছে আমার গাড়ি আমি দিব। কিন্তু উপর থেকে নামায় আনার জন্য দুজন দরকার। সেই গাড়িতে আমি, বাদল, স্বপন, বদি, কাজী কামাল। আমি গাড়ি নিয়ে নীচে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাদল,স্বপন, বদি, কাজী কামাল উপরে চলে গেল। ভেতর থেকে কেউ জানতে চাইলে বাদল পরিচয় দিল, আমি বাদল মামা। প্রিন্সিপাল মহিলা। দরজা খুলেছেন। বাদল বলল, বাচ্চাটাকে একটু দেখি। বাচ্চাটি বাদলকে চেনে। আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম বলার জন্য যে, মা এসেছে, বাচ্চা দেখিয়ে আবার দিয়ে যাব। উনি দিতে রাজি হলেন না। বলতে না বলতে স্বপন করল কি ফায়ার করে দিল। তার কোমরে রিভলভার ছিল। ওই ম্যানসানে দুইজন ব্রিগেডিয়ার থাকে ও একজন সিনিয়র পাঞ্জাবী পুলিশ। আমি নীচে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বসে আছি। ভাবীর থেকে কেচি আর আমার ভাইয়ের ছেলের প্যান্ট শার্ট নিয়েছিলাম। এটা কেন করলাম? ওরা যদি ওয়্যারলেসে বলেও দেয় একটা মেয়ে বাচ্চা কিডনাপড হয়েছে তো আমরা তাকে ছেলে বাচ্চা বানাব। ফায়ার করার পর বাচ্চা চিৎকার করছে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। তখন টেলিফোনের শব্দ স্বপন লক্ষ্য করেছে। টান দিয়ে তার ছিঁড়ে ফেলে দিল। একটা বাচ্চাকে নিল, আরেকটা বাচ্চাকে নিতে গেল। সে বাচ্চাটা খাটের নীচে খাটের পা ধরে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। বড় বাচ্চাটি কাঁদতে আরম্ভ করেছে। তারপর বগলদাবা করে বাচ্চাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে আরম্ভ করেছে। তখন দেখল আর একটা টেলিফোন বাজছে। টান দিয়ে ওটার তারও ছিঁড়ে ফেলল। দুইটা টেলিফোনের তার ছিঁড়ে ফেলল। ওইটা বোধহয় ডাইরেক্ট আর্মির টেলিফোন ছিল।
গুলির শব্দ শুনে ঐ ফ্লাটের সবাই দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। খবর দিয়েছে বোধহয় আর্মিকে যে এখানে অ্যাটাক হয়েছে। তারটা ছিঁড়ে বড় বাচ্চাটিকে বগলদাবা করে গাড়িতে উঠান হল। আমাদের একটা জায়গা ছিল, নারায়ণগঞ্জে যাবার পথে এক জায়গায় নৌকা দাঁড়িয়ে থাকে। ওখানে শাহাদাত আর আলম বোধহয় থাকবে, আমরা নৌকাতে বাচ্চা দিব, আর ওরা নৌকা নিয়ে নদীর ওপারে চলে যাবে। আমি গাড়ি চালিয়ে মাত্র ১৯ মিনিটে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ এসেছি। আমরা গাড়ির মধ্যে করলাম কি ওর চুল কাটলাম, কেটে জানালা দিয়ে ওর চুল ফেলে দিলাম যাতে গাড়িতে চুল না থাকে, প্যান্ট শার্ট পড়ালাম ছেলের মত। ওতো কাঁদছে। আমরা বললাম, “মামা এই তো তোমার আম্মু এখানে।” এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছি ডানে-বামে কোন কিছু খেয়াল করছিনা। প্রিন্সিপালকে বলা হল আমরা গুলশান যাচ্ছি। উনাকে আর্মি এসে জিজ্ঞাসা করলে উনি গুলশানের কথা বলবেন। আমরা বুদ্ধি করে গুলশানের কথা বললাম কিন্তু যাচ্ছি নারায়ণগঞ্জ। আর রাস্তায় চেকপোস্ট ও ব্যারিকেড যদি বসায় তাহলে ওরা দেখবে ছেলে। কিন্তু ওরা তো খুঁজবে মেয়ে। ওদের মাথায় এতটা বুদ্ধি হবে না। আমরা একটা বাচ্চা নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। আরেকটা খাটের তলায় ঢুকে খাটের পায়া ধরে চিৎকার করছিল। শাহাদাত চৌধুরী অথবা আর কেউ নৌকাতে অপেক্ষা করছিল। নৌকা নিয়ে ওপারে গেলেই তারপর গ্রামের দিকে চলে যাবে। আমি আর স্বপন আরামে আসলাম, ভাবলাম আমরাও তো টার্গেট হতে পারি। আমাদের চুল বড়। আমরা দুজন নেমে চুল কেটে ছোট করে ফেললাম। একদম চেইঞ্জড, যাতে কেউ চিনতে না পারে। তারপর বাসায় আসলাম। ভাইয়া বলল, “কি হাতি ঘোড়া মেরে আসলে?” বলার পর বললেন, “না এটা খুব রিস্কি কাজ করেছ কারণ ঐ গাড়ি নিয়ে তোমরা এখানে আসছ, ওরা যদি ঐ গাড়ির নম্বরটা দেখে রাখে?” আমি নম্বর প্লেট সরাতে পারিনি, আমি যে কাজটা করেছিলাম, গাড়ির একটা নম্বর কাদা দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম। ওরা যদি নোটও করে তাহলে তিনটা ফিগার পাবে। গাড়ির কালারটা চেঞ্জ করতে পারিনা। হলুদ। যেটা করেছি কিছু স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছি পুরো গাড়িতে।
আমি আর স্বপন হাসছি গাড়ির মধ্যে। স্বপন বলল, আমাকে মালিবাগ মোড়ে নামিয়ে দাও। নামিয়ে দিলাম। সে থাকে মালিবাগে। ফিরে আসলাম বাসায়। আমি বাসায় আসার পর দেখলাম রুমী আর বদি বসে আছে। ভাবী খাবার দিয়েছে, ওরা খেয়েটেয়ে বসে আছে। আমরা তিনজন মিলে গল্প করলাম। দুপুরে তিনজন মিলে ঘুমিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা বেলা আমরা বের হলাম। আলম আসবে, শাহাদত চৌধুরী আসবে, আমাদের একটা মিটিং আছে যে কোথায় এরপরে অপারেশন। ঠিক হল আমরা আজিমপুর গার্লস কলেজ অ্যাটাক করব। পরীক্ষা হওয়ার কথা, আমরা গ্রেনেড মারব। বলব তোমরা পরীক্ষা দিওনা। আমরা রটিয়ে দিতে চাই পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যে ওখানে অ্যাটাক হবে। বিল্ডিং-টিল্ডিং সব উড়ায়ে দেব। আমরা সব প্ল্যান করেছি। আলম আমাকে বলল, খালার বাসায় কিছু আর্মস, মানে গ্রেনেড-ট্রেনেড রয়েছে। ফসফরাস গ্রেনেড। মারলে আগুন ধরে যায়। ওগুলো নিয়ে আসতে। আমি দেখলাম যে দুপুর বেলায় তো চেকপোষ্ট বসে না। চলে গেলাম আনতে। বিকালে ২৮ নম্বরে দেখা হবে। মায়াকে পৌঁছাতে হবে। মায়া এ কাজটা করবে। আমি আর্মস নিয়ে গ্রেনেড আর ফসফরাস গ্রেনেড নিয়ে গাড়িতে আসব। আমার খালাতো ভাই বলল আমি দেখব। তুমি চেকপোষ্ট পার হও কি ভাবে? কত বড় মুক্তিযোদ্ধা তুমি, আমি দেখব। তুমি দেখবে যদি আমি ধরা পড়ে যাই আমার কাছে তো কোন আর্মস নেই। যদি ধরা পড়ি তবে গুলি করে পালাব তাও তো না। আমি তো ভদ্রলোকের মত টাই স্যুট পরা, আমাকে যেতে দিবে। আমি ওকে নিয়ে ধানমন্ডি থেকে বেড়িয়েছি। দেখি সাইন্স ল্যাবরেটারিতে চেকপোস্ট। তখন ডানে বামে যাওয়া যাবে না। মাঝখানে আইল্যান্ড। আমি তো আল্লাহ আল্লাহ করছি। আমি তো গেলামই আর একে নিয়ে এখন কি করব? এই ব্যাচারা। আমি তখন তাকে আস্তে আস্তে বললাম, তোমাকে মানা করলাম যে তুমি এসোনা কোথায় কি বিপদ হয়। আমি মাথায় বুদ্ধি আটলাম কি করি। কি করি? আমরা একটা জিনিস করতাম গাড়ির মধ্যে কিছু ঔষধ রাখতাম। যে কোন ঔষধ, ভাল খারাপ ঔষধের প্যাকেট রাখতাম। আমার সামনে ২টা গাড়ি। হল্ট হল্ট করছে। ওদেরটা চেক করছে।
আমারটা এসেছে। আমি গাড়ি থামিয়ে, পা গাড়ি গিয়ারে রেখে, গাড়ি থেকে নামিনি, জানালা দিয়ে বলছি যে দেখ আমার নানি খুব অসুস্থ, মেডিকেল কলেজে যাব। একদম ডেথবেডে। ঔষধটা পৌঁছানো খুবই জরুরি। জীপে একজন ক্যাপ্টেন বসে আছে। চারজন মিলিটারি পুলিশ। গাড়ি থেকে নামতে বলে আর দরজা খুলে চেক করে। আমি বললাম, “দেখ, এই ঔষধটা খুবই জরুরি আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। না দিলে উনি মারা যাবে। তবু বলছে, “উতরো উতরো।” আমি বললাম যে নামছি। একটা পা বের করছি ক্যাপ্টেন বলছে যে, “যিধঃ’ং ৎিড়হম রিঃয ুড়ঁ মবহঃষবসবহ? ” আমি বললাম, “ঘড়ঃযরহম ৎিড়হম, সু মৎধহফসড়ঃযবৎ রং াবৎু ংরপশ. ও ধস পধৎৎুরহম ঃযরং সবফরপরহব. ” ওই সিপাইটাকে বলল, দেখে তো ভদ্রলোক মনে হয়, ছেঁড়ে দাও। আর আমার কাজিনটা ছোট। সেও ঘাবড়ায়ে কান্নাকাটি করছে। সিচুয়েশনটা খুব মজার ও ড্রামাটিক হল। ক্যাপ্টেন যখন বলল যে ঠিক আছে যেতে দাও। আমার আর ওই সিপাহী বন্দুক ধরে রেখেছে কিনা দেখার সময় নেই। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করা ছিল, ক্লাচে ছিল, দরজা ঠিকমত বন্ধও হয়নি। একেবারে ফুল স্পিড, পার হয়ে যখন কিছুদূর আসলাম, আমার তো ঘাম। আমার কাজিন আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুখ থেকে একটা কথাও বের হচ্ছেনা। “এত উপস্থিত বুদ্ধি তোমাদেও,” সে বলল। আমি বললাম, মানুষ বাঁচার জন্য অনেক কিছু করে তখন। আমার মৃত্যুর জন্য না তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। ধর তোমাকে পেটালে তো তুমি সব কিছু বলে দিতে। আর্মস আছে। এখানে আছে সব। যাই হোক আর্মস মায়ার কাছে পৌঁছিয়ে দিলাম। তারপরদিন মায়ারা বোধ হয় একটা অ্যাকশন করল আজিমপুরে হোম ইকোনোমিকস কলেজ। বোধ হয় ট্রেনেও গ্রেনেড মারল। পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য। এই চলল আমাদের যুদ্ধের কাহিনী।
আমি আর আলম। তেজগাঁওয়ের পিছনে একটি নদী ছিল। একদিন সকালে শাহাদত ভাই এসে আমাকে বলল, নদীতে আমাদের আর্মস এসেছে। যাও নিয়ে আস। ওটা আনতে হবে। ছালাতে জড়ানো অনেক স্টেনগান আছে, অনেক বুলেট আছে। আমরাতো খুশি। আলমকে বললাম, আমি একা তো পারবনা, চল আমরা দুইজন যাই। প্রচুর বৃষ্টি সেইদিন। সকাল বেলা গেলাম। আর্মস নৌকা থেকে নামিয়ে দিল। একেবারে নদীর ধারে। ওখানে চালের গুদাম ছিল। গাড়িটা রাখলাম মুখটা ঘুরিয়ে। মানে রাস্তার দিকে সোজা করে রেখে আমি গাড়িতে বসে আছি। আলম গিয়ে ওদের ইশারা করছে। ওরা এনে এনে গাড়িতে দিচ্ছে। তখন তো লোকজন কম রাস্তা ঘাটে। দুই-একজন হাঁটছে। দেখছে যে আমরা ছালাতে ভরে কিছু রাখছি। আমাদেরকে দেখছে প্যান্ট-শার্ট পড়া। ওরাতো বুঝে গেছে। বলছে ভাই আজ রাতে কোথায় হবে? বললাম, ভাগেন। কারণ আস্তে আস্তে ভিড় হয়ে যাবে। পুলিশ আসবে। আর্মি আসবে। তারপর ভাগিয়ে দিলাম। আমি আর আলম আর্মস নিয়ে গাড়িতে রেখে গাড়ি চালিয়ে আসছি। তখন ফার্মগেটে ডান দিকে ঘুরার রাস্তা ছিল। জাস্ট ফার্মগেটে আসছি। হঠাৎ দেখি চেকপোষ্ট। নরমালি সকাল বেলায় চেকপোস্ট বসে না ভিড়ের জন্য। আমি আর আলম এসে দেখলাম সামনে চারটা গাড়ি। সব সার্চ হচ্ছে। পুরা গাড়িতে আর্মস ভর্তি আর ছালাতে জড়ানো। কি করব এখন? হাতেও নেই যে গুলি করি। যা হবার হবে। আলম বের করতে যায় আমি বলি দাঁড়াও বুদ্ধি করি। এক কাজ করি এই গাড়ির পিছন পিছন যেতে থাকি। আমরা ডান দিকে থাকব। ওরা সব গাড়ি সার্চ করে ছেড়ে দিচ্ছে। আমরা ডানদিকে রয়েছি। আমি আলমকে বললাম চুপ করে বসে থাক। আমাদের টার্ণ আসল। হল্ট। পুরা স্পীডে টার্ণ নিয়ে শেরেবাংলা নগরের দিকে। আলম তো পাশে বসে। আলম ঘুরে দেখছে, বলল দুটো মোটর সাইকেল চেজ করছে। আমি বললাম রাখ, গাড়ির পিছনে মোটর সাইকেল? গাড়ি মোহাম্মদপুর, অলিগলি এদিক সেদিক ঘুরে ২৮ নম্বরে আমাদের বিল্ডিংয়ের পিছনে রেখে দিলাম। ওরা তো বুঝতে পারেনি, টেরও পায়নি, গাড়ি হল্ট করেছে। আমি ইন্ডিকেটর দিলাম যে নামব, তারপর পৃথিবীর সমস্ত স্পীড উঠিয়ে গাড়ি চালিয়ে এই বাঁচা বেঁচে গেলাম। ঞযধঃ রং অহড়ঃযবৎ ংঃড়ৎু। তারপর দেখলাম যারা যুদ্ধ করেনি ওহফরধহ বর্ডারে বসে থাকত তারা এটা নিয়ে ‘ওরা ১১ জন’ নিয়ে ছবি করেছে। আমরা হাসতাম। ঢাকা শহরে যুদ্ধ করতে প্রচুর সাহসের দরকার হয়। নিজের গাড়ি। এমন না যে অন্যের গাড়ি ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেলাম। গাড়ি আমার। রেজিস্ট্রেশন আমার নামে। বাড়ির ঠিকানা আমার। গাড়িটা ধরতে পারলেই সব পেয়ে যেত।
২৯শে আগষ্ট মধ্যরাত। আমি তখন আমার ভাইয়ের সঙ্গে থাকি। ধানম-ি অপারেশনের পর আলমরা সব চলে গেল ইন্ডিয়া। আমি রয়ে গেলাম, বদি রয়ে গেল, রুমী রয়ে গেল, আরও কয়েকজন। এর মধ্যে জুয়েল ইনজুরড হয়ে গেল। আঙ্গুলে গুলি লেগেছিল। তারা রেকি করতে গিয়েছিল। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ায় ষ্টেশনে নৌকায় করে সেখানে বোধ হয় গোলাগুলি করে তার আঙ্গুলে গুলি লেগেছিল। সে তখন আজাদ ভাইয়ের বাসায় ট্রীটমেন্টে ছিল। আজাদ ভাইয়ের বাসায় তখন সবাই থাকতে আরম্ভ করল। কাজি কামাল উদ্দিন সহ আরও কয়েকজন। আর আমার বাসায় এসে কয়েকজন থাকল। কোন রাতে বদি এসে থাকত। কোন সময় থাকত না। বদির একটা খারাপ নেশা ছিল প্রচুর তাস খেলত। আর পড়াশোনাতো ছিলই। হয় পড়বে, না হয় তাস খেলবে, না হয় অ্যাকশন। ছাত্রনেতা হিসেবে সে এন.এস.এফ করত, মুসলিম লীগের ছাত্র গ্রুপ। সে আমাদের সাথে জয়েন করেছিল। তার যে বন্ধুবান্ধব ছিল তারা এন.এস.এফ করত। তারা বদিকে দুইবার জিজ্ঞেস করেছিল তুমি মাঝে মাঝে কোথায় গায়েব হয়ে যাও, মাঝে মাঝে দুই/তিন রাত থাক না। ও বলে, এই তো এখানে ওখানে ছিলাম। বদি তাস খেলছিল ধানম-ির একটি বাসায়। আমাকে বদি যা বলল, ওখানে (এমপিএ হোষ্টেলে) কিছু কথা হয়েছিল আমার আর বদির মধ্যে। সে তাস খেলছিল ফরিদ নামের একজনের বাসায়, ধানম-িতে থাকে। আমাদের প্রত্যেকের পকেটে পটাশিয়াম সায়ানাইড থাকে যে ধরা পড়লে মুখে দিয়ে দিবে। বদি তার শার্টটা আলনায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। সে দিন ছিল গরম, আগষ্ট মাসে ভ্যাপসা গরম ছিল। সে শার্টটা আলনাতে ঝুলিয়ে দিয়ে গেঞ্জি পড়ে তাস খেলছিল। বদি ধরা পড়ল বেলা ১২টার দিকে। যে বাসায় বসে তাস খেলছিল সেই ইনফর্ম করেছে আর্মিকে। বদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে ছিল পাকিস্তানি মাইন্ডেড। বদি বুঝতে পারে নাই। তার বন্ধুর সন্দেহ হল যে বদি দুইদিন তাস খেলল, তিনদিন তাস খেলল তারপর হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। তখন ওর সন্দেহ হল, বদি যায় কোথায়? তারপর ১২টার সময় ঘটনা।
বদি বলে, “আমি তাস খেলছি যার বাসায়, সে খুব অস্থির, একবার উঠে যাচ্ছে, আবার আসছে, উঠে যাচ্ছে আবার আসছে। তো হঠাৎ সে জানালা দিয়ে দেখে পুরা বাড়িটার চারিদিকে ট্রাকে করে আর্মি নামছে। বদি বুঝে গেছে। আর কিছু না, ইনফরমেশন চলে গেছে। বদি করল কি তার শার্টটা নিল, পিছনে একটা দেয়াল ছিল। সে লাফ দিয়ে দেয়ালে উঠবে আর তখনই বোধহয় পকেট থেকে তার পটাশিয়াম সায়ানাইডটা পড়ে যায়। সে তখন পকেট হাতাল, দেখল নাই। সে তখন দৌঁড় মারল পাঁচিলের দিকে। পাঁচিল টপকিয়ে ঐ পারে গেলে কি হয় জানি না। বলল, আমি দৌঁড়ে পাঁচিলে উঠতে না উঠতেই আমার পিঠে বন্দুক ঠেকাল। কিধার য্যাতা হ্যায়? ন্যাচেরালি বদি নামল। বলল, “তুম বদি হ্যায়?” বদি বলল, “হ্যা আই অ্যাম বদি।” “বদি হ্যায়তো ভাগা কিউ?” ও নিজের কিছু ব্যাখ্যা দিল তাদেরকে। বদি জানে তারা খবর নিয়েই এসেছে। ১২টা থেকে তাকে টর্চার করছে। তোমার দলে আর কারা কারা আছে তুমি তো একা নও। ১২টা থেকে টর্চার করতে করতে সে কারো নাম বলেছে। কিন্তু আমার নাম বলেনি, রুমীর নাম বলেনি। সে বোধ হয় তাদের নাম বলেছে যারা ইন্ডিয়া চলে গিয়েছে। আরেকজনের নাম বলেছে। সামাদ বলে একজন ছিল। সামাদের নাম বলেছে। বদি বলল ১২টা থেকে ধরা পড়ে টর্চার করতে করতে রাত ৮/ ৯ টা পর্যন্ত যখন দেখলাম আমার সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছে তখন আমি সামাদের নাম বলেছি। বদিকে তখন ওখানে নিয়ে গেছে জীপে করে। “এই সামাদ?” বদি বলে, “হা এই সামাদ।” সামাদ কে থাপ্পড় মারার সাথে সাথে সে বলে, “আমাকে মেরোনা আমি সব বলে দিব। আমার বৌ-বাচ্চা আছে, আমাকে মেরোনা।” এই সামাদ আরম্ভ করল।
আলতাফ মাহমুদ থেকে শুরু করে প্রত্যেকের বাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তারপর ২৮ নম্বরে নিয়ে গেল। সামাদ কিন্তু আমি যেখানে থাকি ভাইয়ের বাসায় সেইটা চিনত না। সেও মুক্তিযোদ্ধা ছিল, যুদ্ধে জয়েন করেছে, সে হয়ত তার বউ-বাচ্চার কথা চিন্তা করে বলে দিয়েছে। বদি আমাকে যা বললো ও দুই থাপ্পড়ে সবার নাম বলেছে। বদি কথা বলতে পারছিলনা, গোঙ্গাচ্ছিল। সে বলল আমি তোমার নাম বলেছি কিন্তু জায়গাটা বলি নাই। বদি কিন্তু আমার বাসায় থাকত। বলেছে আমি ওকে [চুল্লু] নামে চিনি। আমাদের সঙ্গে ছিল কিন্তু কোথায় থাকে জানিনা। এই করতে করতে ২৮ নম্বরের কথা সামাদ বলল। সন্ধ্যা বেলা মানে ৭-৮টার দিকে আর্মি ওখানে গিয়ে পৌঁছাল। দুইজন দারোয়ান ছিল। একজন দারোয়ান যখন দেখল যে, গাড়ি থেকে আর্মিরা দরাম দরাম করে নামছে ও পিছনের দরজা দিয়ে ভেগে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে কি করে ওরা। সামনেই একজনকে পেয়ে গেল, তাকে ধরে থাপ্পড়-টাপ্পর মারল। বলল, “স্যার কিধার?” ও বলল, “স্যার তো এখানে থাকে না, কোথায় থাকে?” কোথায় যেন থাকে, অফিস তো এটা। ওরা ভিতরে ঢুকে চক্কর-টক্কর দিয়ে দেখল টেবিল চেয়ার লাগান।ওরা বেরিয়ে আসল। তারপর ওরা আবার থাপ্পড় মেরে চলে গেল। সেই যে আরেকটা দারোয়ান সে করেছে কি পালিয়ে এলিফেন্ট রোডে এসে বলল, আপনাদের মধ্যে একজন ধরা পড়েছেন ছিপছিপা লম্বা কালো মত। আরেকজন আছে গাড়িতে। সামাদকে ও চিনতে পারেনি। আমাকে যখন বলেছে তখন আর আধা ঘন্টা বাকি কারফিউ শুরু হয়ে যাবে। আমি তাকে বললাম ভাগো। আমি তখন ভাইকে বললাম, ভাই আমি চলে যাই। আমার শার্ট-প্যান্ট ভাবি দিয়ে দিল।
ভাই তখন বলল একটু পরেই তো কারফিউ হয়ে যাবে। রাস্তায় ব্যাগ নিয়ে ধরা পড়লে তো আরো বিপদ। দেখনা কি ঘটে? এ বাড়িতো কেউ চিনেনা। আর আমরাতো জানতে পারছি না কে ধরা পড়েছে। বদি ধরা পড়েছে না কে? পরে জানলাম বদি। আমাকে দারোয়ানটা বারবার বলছে, আপনার সঙ্গে বেশি ঘুরতেন। তখন বুঝলাম যে বদি। দারোয়ান বলল আমি উনাকে জীপে দেখেছি চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা পিছনে। উনাকে আমি চিনতে পেরেছি। আর একজন আছে, সেইজন উনাদের সাথে কথা বলছে। সামাদ আমার বাসা চিনতনা। সামাদ ২৮ নম্বরটা চিনত। যাইহোক, রাত ১০/১১ টা বেজে গেছে। কারফিউ আরম্ভ হয়েছে। দারোয়ানটাকে ভাগিয়ে দিলাম। আর বললাম তুমি ঐ অফিসের ধারেকাছেও যাবে না। সোজা দেশে চলে যাও। আর একজন ছিল সে কোথায়? বলল সে পালিয়ে চলে গেছে। বললাম ঠিক আছে। আর আমার বাসায় তখন আর্মস ভর্তি, গ্রেনেড আছে, এটা আছে, ওটা আছে। আমি চিন্তা করছি কোথায় রাখি? বাড়িতে বাগান পিছনে। কিন্তু পিছনে বারান্দাগুলো থেকে যদি কেউ দেখে যে মাটির খুঁড়ে কিছু রাখছে। মানে বাড়ির পিছনে আলো জ্বলছে। আদমজী বিল্ডিংয়ের পিছনে সিকিউরিটি গার্ড, ওরা তো সব দেখতে পারে। আমি ওয়াশরুমে টয়লেটের ড্রেনটা খুলে ওর ভেতরে পলিথিনে রাখলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল যদি কিছু না হয় তাহলে যাতে পরে ব্যবহার করা যায়। পলিথিন ব্যাগের মধ্যে জড়ালাম যাতে পানিতে নষ্ট না হয়ে যায়। তারপর ওর ভিতর নামিয়ে দিলাম। নামিয়ে দিয়ে দেখি লাইট দিলে চিকচিক করছে। কি করি? ভাইয়ের দুইটি কালো মোজা নিয়ে আসলাম। এনে ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিলাম। দিয়ে হাত দিয়ে কাঠি দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম। এবার টর্চ লাইট মেরে দেখি আর দেখা যায় না। টর্চ মারলেও ভাববে অনেক নীচে অন্ধকার। আমি তখনও কিন্তু সন্দেহ করছি না এখানে কিছু হবে। কিন্তু আমার মন যেন বলছে, ভাইও দেখছি ছটফট করছে। কে হতে পারে কালো? আমি কিছু বলতে পারছিনা। আরেকজন ছিল কালো। সে হলেতো এই বাসা চিনেনা। বদি হলে তো ডেফিনেইটলি চিনে। আর বদি যদি টরচার্ড হয়। আমাদেরতো ঐ এক্সপার্টাইজ নাই যে টর্চারে বলবনা। রাত তখন দুটো। আমার একটা বড় অ্যালসেসিয়ান কুকুর ছিল। আমার খুব প্রিয়, সে ঘেউ ঘেউ করছে। পর্দাটা সরায়ে দেখি গেটে প্রচুর আর্মি, দেয়াল টপকায় টপকায় ভিতরে ঢুকছে। আমি চিন্তা করছি আমার ভাইরা তো ঘুমিয়ে পরেছে। তুলব না তুলব না। নিজেকে রুমের মধ্যে দরজা বন্ধ করে বসে থাকব।
দেখি না কি হয়? দেখলাম খুব নক হচ্ছে, তারপর বেল বাজচ্ছে। আমার কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করছে। ওদেরকে ভয়ও পাচ্ছে আবার দৌঁড়াচ্ছেও। ভাই উঠে বুঝে গেছে। ভাই দরজা খুলে বলল, কি চাই? একজন বলল, “আমি ক্যাপ্টেন কাইয়ূম, ফিল্ড ইনটেলিজেন্স, ডিজিএফআইয়ের একজন। আপনারা কে কে থাকেন?” ভাই বলল যে তিনি সি.এস.পি অফিসার। “কে থাকবে, আমি আছি আমার মা আছে আমার স্ত্রী আছে আমার ২টা বাচ্চা আছে।” ক্যাপ্টেন বলল, আর কেউ? বলল, হ্যাঁ আমার ভাই আছে। নাম কি? বলল মাসুদ সাদেক। জিজ্ঞাসা করল, উনি কি করেন। ভাই বলল একটা ইউএস কোম্পানীর এক্সিকিউটিভ। বলল, উনার কোন ডাকনাম আছে? আমি কান পেতে শুনছি। ভাই বলল হ্যাঁ আছে। “Sir, if you don’t mind, what is his name. ” ভাই বলল চুল্লু। বলার পর পিনড্রপ সাইলেন্স। একেবারে দুই থেকে আড়াই মিনিট। বলল “উছিকাতো তালাশ হ্যায়।” ওরা তো কনফার্মড হয়ে এসেছে, নিশ্চয়ই পিছনে কেউ আছে। বলল, “Can we talk to him? ” ভাই বললো, “ঙভ ঈড়ঁৎংব, ুড়ঁ পধহ. ” ভাই আমার রুমে নক করে। আমি তো জেগে আছি। আমি খালি চিন্তা করছি, কি করব। প্রথম দেখা হলে কি বলব? আমি নরমালি পাঞ্জাবী পায়জামা পড়ে ঘুমাই। লুঙ্গি টুঙ্গি পড়িনা। ক্যাম্পেও পড়ি নাই। ওরা বলত, “তুমি মড়হব পধংব, সবাই লুঙ্গি পড়ে, তুমি লুঙ্গি পড়না।” জীবনে পড়িনি, পড়তেটড়তে পারিনা। ভাই নক করছে। ভাই বলছে ওর জ্বর ছিল, জানিনা জ্বর সেরেছে কিনা, বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার কানে শুধু একটা শব্দ এলো, নেহি নেহি। “ঐব রং হড়ঃ ংষববঢ়রহম. ঐব রং ঢ়ষধহহরহম. ” আমার রুমে কার্পেট ছিল। কার্পেটের নীচে ঢাকা শহরের যত কালভার্ট ছিল, ছোটখাট ব্রীজ ছিল সব ছবির কপি করা। রুমীর আব্বা দিয়েছিলেন। যাই হোক, আমি দরজা খুললাম, দেখালাম যে আমি ঘুমিয়েছিলাম, চোখ মুছলাম। বড় বড় চোখ করলাম, যত প্রকার নাটক করতে পারি। বলল যে, “ডযধঃ’ং ুড়ঁৎ হধসব,”। মাসুদ সাদেক । মাসুদ সাদেক? ”“উড় ঁ যধাব ধহু পধষষ হধসব? ” বললাম, “ইয়েস, চুল্লু।” তারপর ভাইকে বলল যে আমরা ওকে নিয়ে যাব। কিছু ছঁবংঃরড়হ করব, কাল সকালে ছেড়ে দিব। ভোর হতে তো আর বেশি দেরি নাই। ভাই বলল যে কোথায় নিয়ে যাবেন? ওরা বলল, সেটাতে বলতে পারিনা। ঐরময ঈড়সসধহফ যেখানে নির্দেশ সেখানে নিয়ে যাব। ভাই বলল আচ্ছা ঠিক আছে। দারোয়ানকে ডাকছে এই গেট খুলে দাও। আমি বললাম যে প্যান্ট-শার্ট পড়ে নিই। বলল, না প্রয়োজন হবে না। তুমিতো চলে আসবা। আমি বললাম, না প্যান্ট-শার্ট পড়ে নিই। আচ্ছা পড়ো। প্রথমে ওরা বাথরুম দেখে নিল যে পালাবার জায়গা নেই। আর বাথরুমের বাইরে তো আর্মি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাথরুমে শুধু ঠবহঃরষধঃড়ৎ একটা আছে। প্যান্ট শার্ট পড়ে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। ভাই বলছে, এই দরজাটা খুলে দাও, ওরা যাবে। সে বলছে, “ঘড় হববফ. ঐব শহড়ংি, ঐব শহড়ংি যড়ি ঃড় লঁসঢ় ড়াবৎ ঃযব ধিষষ. ঐব যধাব ধষংড় ঃৎধরহরহম ড়ভ লঁসঢ়রহম।”
ন্যাচেরালি আমি দরজার উপর দিয়ে লাফ দিয়ে নামলাম। কি করব? ওরা জেনে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। যেই আমি পাচিল পার হয়ে রাস্তার উপর দাঁড়িয়েছি, হলি ফ্যামিলির কাছ থেকে একটা জীপের আলো আমার উপরে ধরল, আমাকে বলল, হল্ট, দুইজন ছিল, দুইজন আমাকে ধরে আটকাল-আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, আলো পড়ল, জীপে কেউ ছিল, সনাক্ত করল। ঘুরে দেখল ভাই পিছনে আছেন কিনা? আফটারঅল ভাই ঝবহরড়ৎ এড়াঃ ঙভভরপবৎ, দেখল ভাই দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটু আগে নিয়ে গেল, বাতিটাকে নিভিয়ে দিল, অন্ধকার হয়ে গেল, হাতদুইটা পিছনে নিয়ে হ্যান্ডক্যাপ পড়িয়ে দিল। আর একজন চোখ বেঁধে ফেলল। ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গিয়ে জীপে তুলল। তুলে ধমাধম লাথি, খালি একজনের গোঙ্গানোর শব্দ শুনছি। কে সে বুঝতে পারছিনা। পিছনে হাত বাধা, চোখ বাধা। আমি উঃ আঃ করছি। ওরা কি যেন বলল, ওদের ভাষায় বলল, আর গাড়ি চলল, কোথায় যাচ্ছে আমি জানি না। হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে থেমে গেল গাড়ি। ট্রাক থেকে ধমাধম লাফ দিয়ে নামছে, আমি শব্দ শুনছি। ঙৎফবৎ দিচ্ছে ঃযরং ধিু, ুড়ঁ মড় ঃযধঃ ধিু, আর একটা বাসা জধরফ হচ্ছে বুঝতে পারলাম। ইব পধৎবভঁষ, উধহমবৎড়ঁং ঃযবংব ঢ়বড়ঢ়ষব ধৎব. হঠাৎ ৫-১০ মিনিটের মধ্যে চীৎকার, মেয়েদের চীৎকার। মহুয়া আর কেয়া স্বপনের দুই বোন। স্বপন করেছে কি ও উঠেই টের পেয়ে লাফ দিয়ে ছাদে উঠেছে, পিছনে বস্তি ছিল। ও লাফ দিয়ে বস্তির মধ্যে দৌঁড়। বস্তির মধ্যে একবার ঢুকলে তো কারো বাপের সাধ্য নেই খুঁজে বের করা। পাকিস্তান আর্মি কেন তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠি আসলেও খুঁজে বের করতে পারতনা। ওর বোনদের ধরে নিয়ে এসেছে, অকথ্য ভাষায় গালাগালি, ওর বাপকে ধরে নিয়ে আসল। বাসায় কান্না-কাটি। আবার অকথ্য ভাষায় গালাগালি।
স্বপন, ভাগ গিয়া, স্বপন ভাগ গিয়া, শুনছি আমি। উপরসে জাম্প কিয়া। জোয়ানটোয়ানদেরকে গালাগালি করছে, ঐড়ি রঃ যধঢ়ঢ়বহবফ? ওর বোনদের ধরে নিয়ে এসেছে। একটা বাজে কথা বলল যে, আজকা খোঁড়াক। চল। গাড়িতে তুলল, কান্নাকাটি করছে। ওর বাবা বলল যে, “ওদেরকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছ। আমিতো যাচ্ছি। ওদেরকে ছেড়ে দাও।” ঙভভরপবৎ বলল, খধফরবং ছোড় দো। ও (ক্যাপ্টেন কাইয়ুম) কিন্তু পাঞ্জাবী ছিলনা। পাঠান। ওরাও তো তখন টরচার্ড ছিল। পাঠানরা আবার পাঞ্জাবীদের পছন্দ করতনা। বলল, চল আর গালাগালি আরম্ভ করল। “ক্যায়সা লাড়কা বানায়া?” তারপর গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে এদিক ওদিক। তারপর এক জায়গায় আসল, থামল, আমাদেরকে টেনে নামাল। ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেল, তারপর এক জায়গায় আনল। কারো গোঙ্গানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ও ফড়হ’ঃ শহড়.ি ও ফড়হ’ঃ শহড়।ি রুমীর গলার শব্দ। এখনও যদি স্মরণ করি রুমীর গলা। এখনও বলতে পারি কেমন যেন ভারী গলায় বলত। তখন আমার মাথা ঘুরছে। রুমীতো চলে গেল ইন্ডিয়ায়, না রুমীতো যায় নাই। বদি যায় নাই। তখনও আমি জানি না যে, রুমী, বদি ধরা পড়েছে। আমাকে ধাক্কা দিল, দু-একজন লোকের উপর গিয়ে পড়লাম। তখনও চোখ বাঁধা। জিজ্ঞেস করছে, ঈধহ ুড়ঁ রফবহঃরভু ঃযরং সধহ? ডযড়, যিড় পধহ রফবহঃরভু ঃযরং সধহ? দেখলাম সব চুপ। বলছে, রুমী, তুম বাতাও। বুঝলাম আমাকে ফাইনাল আইডেন্টিফিকেশান হচ্ছে। রুমী বলছে, ও ফড়হ’ঃ শহড়ি যরস। রুমীর কথাও বের হচ্ছে না, প্রচুর টর্চার হয়েছে রুমীর উপর। তারা বলছে, জঁসর ও মরাব ুড়ঁ ধিৎহরহম, ুড়ঁ ধৎব ষুরহম ধমধরহ. একটা অফিসার বলছে, ণড়ঁ ঃবষষ সব, ুড়ঁ শহড়ি যরস ড়ৎ ুড়ঁ ফড়হ’ঃ শহড়ি যরস? রুমী বলছে, ও ফড়হ’ঃ শহড়ি যরস. তারপর রুমী আর্তনাদ করছে, রুমীর উপর আবার টর্চার হচ্ছে। কি যে করছে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তারপর আমাকে ঐ অবস্থায় ওখান থেকে টেনে টেনে নিয়ে আসল। চারিদিকে খালি কান্না আর গোংগানীর শব্দ। আমাকে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে মাটিতে নীল ডাউন করে বসাল। হাত পিছনে বাঁধা, চোখ খুলে দিল। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তারপর দেখলাম টেবিলের উপর বসা লম্বা মত একটা লোক, পায়ে ব্যান্ডেজ। কাইয়ুম আর নাই আমি যাকে দেখেছিলাম।
আরেকজন অফিসার, বললো, যব রং ঈড়ষ ঐবলধলর । ইনি আমাদের ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের চীফ। উনার ভাইকে তো তোমরা কুমিল্লায় মেরে ফেলেছ। আর্মি অফিসার ছিল। কুমিল্লায় খালেদ ভাইরা যাবার আগে যে অফিসার মারা হচ্ছিল তখন ওর ভাই মারা গিয়েছে। আর ওর পায়ে গুলি লেগেছিল । ঢাকা শহরে আমাদের লোক মারছ, বিহারী মারছ, এটা করছ, ওটা করছ। আমি বললাম, আমিতো কিছু জানি না। কিছু জানি না? এখনই বেরুবে। এই বলে কি যেন ইশারা করল কাউকে। পাশের রুমে অন্ধকার। সেখান থেকে বলল, হ্যাঁ এই লিডার হ্যায়। এ আবার বলছে, হ্যাঁ এই হলো লিডার, আর এক লিডার ইন্ডিয়াতে পালাইছে। কার কথা বলল বুঝতে পারলাম না। বলল আরেকটা ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসছিল। একটা বাঙ্গালী ছিল। সে ভাবছে আমি যদি উত্তর দিতে না পারি, আর আমি তো ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছি, আমি বলছি, ও ফড়হ’ঃ শহড়ি ধহুঃযরহম. ও ড়িৎশ ভড়ৎ ধহ অসবৎরপধহ পড়সঢ়ধহু. সবই বেরিয়ে আসবে। তারপর বাঙ্গালীটা বলছে সব বেরুবে, সব বেরুবে। আমি চুপ করে আছি। কারো দিকে তাকাচ্ছি না। কর্ণেল হেজাজী বলছে, আমার পায়ের দিকে দেখছ এখানে তোমাদের গুলি লেগেছে। এর খেসারত তোমাকে দিতে হবে, ণড়ঁ যধাব ঃড় ঢ়ধু ভড়ৎ রঃ। আমি বললাম আমি জানি না, তখন আমাকে বলল, তুমি আস। আমাকে নিয়ে আসল। তখন দেখতে পাচ্ছি বদি, রুমী, আলতাফ, জুয়েল সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখাচ্ছি কাউকে চিনি না। আমার মাথা ঘুরছে। আমাদের সব এখানে? এটা হল কি করে? কে কার বাসায় ছিল মানে আমার মাথা কাজ করছে না। রুমী এক কোনায় গোঙ্গাচ্ছে। জুয়েল পড়ে রয়েছে। আজাদ ভাই কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। রুমীর আব্বা, জামী, উনাদেরকে আলাদা রেখেছে। উনাদেরকে তখনও আমি দেখি নাই। যাই হোক, তারপর আমাকে নিয়ে গিয়ে দুই হাত বাঁধলো জানালার সাথে। তারপর সুবেদার সানি বলে ডাকল, বলল ওই তোমার কাছ থেকে সব কথা বের করে নেবে। ও আমাদের মাস্টার। ও সবার কথা বের করেছে। তোমার নাম কে বলেছে, তোমার বাড়ি কে দেখিয়েছে সব বলে দিবে। ঐব রিষষ ঃবষষ ুড়ঁ বাবৎুঃযরহম, ফড়হ’ঃ ড়িৎৎু। তারপর আরম্ভ হল, প্রথমে তো হাতের মধ্যে, নখের মধ্যে সুই ঢুকালো। তখন চীৎকার করে বললাম, আমি জানি না। কিছুক্ষণ পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর কি হচ্ছিল আমি জানি না।
আমাকে যেখানে নিয়ে গিয়ে রাখল, সেখানে গিয়ে দেখলাম লেঃ আশফাকুছ ছামাদ। তিনি আমাদের দূর সম্পর্কের চাচা হন। উনি আমার ঠিক পাশে। উনি বললেন “দোয়া পড়ো। আর আরেকটা কথা, মরেও যদি যাও, তোমার আর্মস আর অ্যামুনেশান কোথায় আছে কাউকে বলবা না। আমি বললাম, “চাচা আমি আর পারছি না।” বলল, “তোমাকে সহ্য করতে হবে। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। চিৎকার করছে, যিড় রং ঃধষশরহম? তখন আস্তে আস্তে বলছেন, তুমি সহ্য কর। তোমাকে পারতে হবে। তুমি এখানে কাউকে চেননা। একটু পরে দরজা খুলল। আবার বলল, তোমার আর্মস কোথায় আছে? আমি বললাম আমি জানি না। সত্য কথা বলে বাঁচার জন্য সবাই চেষ্টা করে। আমার তখন চাচার কথা মনে পড়ল। আমি জানি না। আমি বললাম, আপনার ভুল হচ্ছে। ওরা বলল, ভুল হয় নাই। তোমার সামনে লোক দাঁড় করাব, তোমাকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলব, তারে চিনবা? আমি বলছি তুমি আন। চাচা বলল, বলে দেও না কেন সব, বলে দাও, আমি তখন কিছু বলছিনা। ওরা তখন বলল, তোমার আর্মস কোথায়? সিগারেট খেয়ে সিগারেটে আগুন ঠেসে ধরে বলে, “দেখছ, দেখ এটা হল অ্যাশট্রে।” চীৎকার করছি, তুমি রাখ আমি বলছি।বলল, এই তাহলে ছেড়ে দেই। ছাড়ল। বললাম, “আমি কিছু ছেলেকে জানি, আসত আমার অফিসে চাকরীর জন্য। আমি সব বানায় থানায় বলছি। অনেকে আইডেন্টিফাই করেছে। বদিকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করছে না। রুমীর কাছে জানতে চাইলে ও বলছে, “না, ওকে আমি চিনি না, দেখেছি ২-১ বার আমার সিনিয়র বন্ধুবান্ধবের সাথে গল্প করত। আমি ওকে দেখেছি ও আমাকে দেখেছে। আমরা হাই-হ্যালো করেছি। আমার সঙ্গে ওর কোন সম্পর্ক নাই। রুমী কিন্তু একেকটা টর্চারে শেষ হয়ে গেছে, মুখ দিয়ে একটি কথাও বলছে না। তখন বলছে, না এ সোজা পথে আসবে না। ওকে (চুল্লুকে) ঝোলাও। এই আমাকে হাত বেঁধে উপরে ক্যাম্পের সাথে ঝুলায় রাখল। খালি পায়ের আঙ্গুলটা কাজ করে। এই যে সকালসন্ধ্যা, সকাল কখন হল আমি জানি না। পানি পানি করেছি, পানি পর্যন্ত দেয়নি। মুখের সামনে গ্লাস এনে ঠাস করে ফেলে দিয়েছে। তোমরা বিহারী মারবা,বাংলাদেশ স্বাধীন করবা, তোমাদের সবাইকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিব।
উর্দুতে বলছে দুধ, আর মধু, ওদের যে প্রাইম মিনিস্টার হবে, তোমাদের ড্রেনের মধ্যে দুধ আর মধু থাকবে। আর কি? এ জন্য তো যুদ্ধ করছ, তোমরা দুধ আর মধুই পাবে ড্রেনের মধ্যে। দুধ আর মধু পাবে। তোমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে আমরা চলে যাব। খুব টিটকারি মেরে কথা। মনে মনে বলছি আল্লাহ তুমি আমাকে এখনি নিয়ে যাও। হয় না একটা মানুষের একটা সহ্যের সীমা আছে। কেউ সিগারেট দিয়ে পুড়াল, কেউ লাথি মেরে ফেলে দেয়। কেউ বলে চেয়ারে বস। আবার লাথি মেরে ফেলে দেয়। তারপর করল কি, লোহার একটা রড নিল, পায়ে রেখে, রোলিং এর মত করে। পাও নাড়াতে পারছি না। তারপর আমাকে বলছে, “তুমি খালি বলে দাও এরা তোমার সঙ্গী সব। আমি তাদের বলছি।” “চিনলে তো বলবো, দেখেছি, ঢাকা শহর ছোট শহর। কত জায়গায় দেখেছি। কোন মতেই শুনতে চায় না। তারপর তিনদিন চারদিন হয়ে গিয়েছে আমার খেয়াল নাই। তারপর দেখলাম আমার আর বদির পায়ে আর হাতে একই ক্ল্যাম্প দিয়ে বেঁধে রেখেছে। তারপর রুমীকে দেখিয়ে বলল, উধার লে যাও। ওকে ওখানে নিয়ে যাও আর এই দুইজনকে এখানে রাখ। তখন বদি আমাকে একটু একটু করে বলছে এই সব ঘটনা ঘটেছে। মাগরিবের আযান হচ্ছে। এরা নামাজ পড়তে গেছে। একটা সিপাহী দাঁড়িয়ে রয়েছে। বদি বলল, “চল এর উপর লাফ দিয়ে পড়ি, গানটা কেড়ে নিই, ২-৪ টা থাপ্পড় মারি তারপর সুইসাইড করি।”
সেপ্টেম্বরের তিন কি চার তারিখের পর রুমীকে আরেক দিকে নিল। বদি বলল আমি টয়লেটে যাবো। ওর পায়ের চেইন আর হাতের চেইন খুলল। আমাকে একটা পিলারের সঙ্গে রাখল। ঐ যে সিপাহীটা দাঁড়িয়ে ছিল, বদি তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে পারছিলনা, উঠে দাঁড়াতে পারছিলনা। বদী আমাকে বলল যে তুমিও জাম্প কর। আমি বললাম, আমাকে তো ক্ল্যাম্প করে রেখেছে। আমি তো দাঁড়াতে পারছিলাম না। আমার হাঁটুগুলো একদম ফুলে গেছে। আমি ওইটুকুই দেখলাম। তারপর কতকগুলো সৈন্য এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বদির উপর। ওকে নিয়ে যাও ঐদিকে। ৪ তারিখ রাতে এসে আমাকে বলল, বদিকো বাংলাদেশ ভেজ দিয়া। তুম সবকো এক এক করকে ভেজ দেগা। উসকো বাংলাদেশ ভেজ দিয়া। বদিকে সম্ভবত ঐ রাতেই মেরে ফেলে। রুমীকো তুমহারা সাথ রাখখেগা আভি। আরেকজন অফিসার বললো, “নো নো, ওখানে প্রচুর ধরে ধরে নিয়ে আসছে। জায়গা হচ্ছে না। আমাদেরকে ৫ কি ৬ তারিখের দিকে রমনা থানায় নিয়ে আসল। ভাবলাম বোধ হয় টর্চার থেকে বেঁচে গেলাম। একেকদিন আসে, নিয়ে যায় ধরে। তারপর থেকে রুমীকে আর দেখি না। এর মাঝে একবার রুমীর পাশে আমাকে রাখা হয়েছিল। রুমী বলল, “কেউ কিছু বলেনি, সামাদ সব বলে দিয়েছে। সবার নাম বলে দিয়েছে, আলতাফ মাহমুদের নাম, তোমাদের সবার নাম। আলম, শাহাদত, ফতেহ আলী এরা সব পালাইছে ইন্ডিয়াতে, এদের সবার নাম বলে দিয়েছে। ওদের কি কোন খবর দেয়া যায়, না আসতে?” আমি বললাম, “ওরা বোধ হয় খবর পেয়ে গেছে।” এই করতে করতে একদিন আমাকে চোখ বাঁধলো, চোখ বেঁধে রমনা থানায় নিয়ে আসল। এই যে ছাড়াছাড়ি হল আমার রুমীর সঙ্গে আর দেখা হয় নাই। ৪/৫ তারিখের পর রুমীর সাথে আমার আর দেখা হয় নাই।

তারপর আমাদেরকে নিল। ইন্ডিয়া এ্যাটাক করে বসল। তারপর আমাদেরকে নিল সেন্ট্রাল জেলে। ওখানে সেলের মধ্যে রেখেছে। সেলের মধ্যে থেকে বের হতে দেয় না। না বাথরুম, না কিছু। এর মধ্যে আমার ভাইয়েরা গভর্ণরকে লিখলেন যে, আমার ভাইকে নিয়ে গেছে। গভর্ণরের সেক্রেটারি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনি বললেন, ঠিক আছে ও অন্যায় করেছে, ওকে ট্রায়াল দাও, দিয়ে মেরে ফেলে দাও। ট্রায়াল আরম্ভ হচ্ছে আমাদের, মার্শাল সামারী কোর্ট। একবার দুবার আমি গেছি ট্রায়ালে। দুইটা ফাঁসি হল আমার চোখের সামনে। আমাকে যে খাবার দিত সে বলল, “জানেন আপনাদের দুইজন মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হয়েছে।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এরা কারা তুমি বলতে পারো?” “আমি তো বলতে পারি না। এরা পিআইএতে চাকরি করত।” আমি এই প্রথম ইমোশনাল হয়ে কেঁদে ফেললাম।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: রুবিনা হোসেন
তারিখঃ২৪/১০/২০০৯