ছাগল কোম্পানী ও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে রংপুর

সম্পাদকের নোট: ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ব্রিটিশ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।এই অঞ্চলের আধুনিক ইতিহাসে এটি অন্যতম বড় ভূমিকম্প। আসামের শিলংয়ে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলেও প্রায় চার লক্ষ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে এর প্রভাব অনুভূত হয়। পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চল এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে তার বিস্তারিত বিবরণ অপ্রতুল। আর এই ব্যাপকমাত্রার প্রাকৃতির দুর্যোগের সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনে অভিঘাতও তেমন একটা আলোচনায় আসেনি। এই প্রেক্ষিতে খ্যাতনামা আলেম ও স্বাধীনতা সংগ্রামী  মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) এর আত্মজৈবনিক লেখাটি খুবই প্রাসঙ্গিক।

লেখক: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী

সচরাচর আমাদের দেশের আলেম সমাজ যেভাবে জীবিকার্জ্জন করেন অর্থাৎ জানাজার নমাজ পড়িয়া, কবর জেয়ারত করিয়া, রুহ শেফাতের জন্যে কোরআন পাঠ করিয়া অথবা মৌলুদ পাঠ ও ওয়াজ করিয়া পারিশ্রমিক গ্রহণ করা প্রভৃতি আমি স্বাভাবিক ভাবে ইহার বিরোধী ছিলাম।ঐ রুপ করা যে ধর্ম্ম বিধি অনুসারে বৈধ বা অবৈধ সেই তর্কের জন্য নহে বরং আমার রুচির জন্যই আমি ঐ নীতির অনুসরণ করিয়া আসিয়াছি। সর্ব্বদাই ভাবিতাম কোনরুপ স্বাধীন ব্যবসা অবলম্বনে জীবিকা নির্ব্বাহ করিব। তাই গোড়াতেই হাকিমী পড়িয়াছিলাম। কিন্তু ঐ ব্যবসা আরম্ভ করার কোন সুযোগ এই যাবৎ ঘটিয়া উঠে নাই।

রংপুরে এক বৎসর কাটিয়া যাওয়ার পর স্বাধীন ব্যবসা করার প্রবৃ্ত্তি ক্রমে প্রবল হইয়া উঠিল। মাদ্রাছায় শিক্ষকগণের সহিত সর্ব্বদাই আমি ঐ বিষয় আলোচনা করিতাম, তাহাদিগকে স্বমতে আকৃষ্ট করিবার প্রয়াস পাইতাম। পরিণামে বাংলা শিক্ষক মুনশী কেরামত উল্লাহ ও অন্যতম আরবী শিক্ষক চট্টগ্রামের সাতকানিয়া চুনতীর মৌলভী ছাআদউদ্দীনকে দলে ভিড়াইয়া যৌথ মূলধনে একটি  ক্ষুদ্র ‘ ছাগল কোম্পানী’ করাইব ঠিক হইল। আমরা তিনজনে মিরিয়া ৪০/৫০ টাকা মূলধন সংগ্রহ করিয়া ছুটির দিন ও মাদ্রাছার ছুটির পর নিকটবর্তী হাট হইতে ছাগী ও পাঁঠা কিনিতে আরম্ভ করিলাম।পণ্ডিত সাহেব ও আমিই সচরাচর হাটে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করিতাম। অন্য মৌলভী ছাহেব ছুফী গোছের ও আমাদের চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন বলিয়া তাঁহাকে ঘরে পাহারায় রাখিয়া যাইতাম।

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ নীলফামারি স্টেশন চত্বর। ১৮৯৭। ছবি: ফ্রিটজ ক্যাপ এন্ড কোম্পানি। সুত্র: আর ডি ওল্ডহ্যাম মেমোয়ার্স

রংপুর কোর্টের নিকট একটি ক্ষুদ্র মাঠ আছে। ঐ মাঠে ছাগল চরাইবার সুবিধা হইবে খেয়ালে আমরা কাজে নামিয়াছি মাটের পশ্চিম পার্শ্বে পণ্ডিত ছাহেবের একটি ক্ষুদ্র বাসা ছিল। সেই বাসার একটি কুঁড়ে ঘরে ছাগল রাখার ব্যবস্থা হইল। ২/১টি ছোট চাকর ছোকরাও রাখা হইল। মাসের মধ্যে প্রায় ৪০/৫০ টি ছাগল সংগ্রহ করিয়া লওয়া হইল। ছাগলগুলি মাঠে ছাড়িয়া দেওয়া হইত এবং রাখাল বালককে লক্ষ্য রাখিবার জন্য নিযুক্ত করা হইল কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে কয়েকটি ছাগল হারাইয়া আমরা ২ টা করে ছাগলকে একসঙ্গে রশি দিয়া বাঁধিয়া দিলাম। তাহাতেও দেখা গেল কয়েকদিনের মধ্যে জোড়া জোড়া ছাগল হারাইয়া যায়।আমরা যখন মাদ্রাছায় এগারটা হইতে ৪টা পর্যন্ত পড়াইতে থাকি ঐ অবসরে ছাগল হারাইয়া যায়। অদৃষ্টের বিড়ম্বনা দেখিয়া ভাবিতে লাগিলাম প্রতিকারের উপায় কি!  আবার ৪/৫টাকে এক সঙ্গে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া চরিবার জন্য মাঠে ছাড়িয়া দিতে লাগিলাম আর চাকর ছোকরার প্রতি কাঠোর শাসন চলিতে লাগিল।

এই ভাবে মাসেক কাল কাটিয়া যাওয়ার পর একদা মোহররম চাঁদে আমি ও আমার ২/৩ জন শিক্ষক বন্ধু মৌলবী ছৈয়দ আবুল ফতাহ ছাহেবের মুনশী পাড়াস্থ দালানের সম্মুখে  Scrinc Canal এর তীরবর্ত্তী রাজপথে দণ্ডায়মান আছি এমন সময় পূর্বদিক হইতে রেলওয়ে ট্রেইন যাতায়াতের শব্দের ন্যায় ভয়ঙ্কর শব্দ শ্রুত হইতে লাগিল আমরা প্রথমে মনে করিলাম স্টেশনের নিকট দিয়া ট্রেন যাইতেছে। স্টেশন সেইখান হইতে তিন মাইল দিনের বেলায় সচরাচর ঐ রুপ শব্দ শোনা যায় না। ঐ শব্দ নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল আমরা আশ্চর্যান্বিত হইয়া পূর্ব্বদিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলাম। আর আরেকবার পূর্ব্বমুখী Scrinc Canal  বা প্রণালীর দিকে তাকাইয়া দেখিলাম প্রণালী বালু  ও মাটিতে ৫/৬ হাত উচ্চ হইয়া ভরাট হইয়া অতি দ্রুতবেগে পশ্চিম মুখে আসিতেছে। দেখিতে দেখিতেই ভূমি কম্পন আরম্ভ হইয়া গেল।এত প্রবল কম্পন আরম্ভ হইল যে কাহারো পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব হইলনা। অনেকে গড়াগড়ি করিয়া মাটিতে পড়িয়া  গেল।

আমার সম্মুখে একটি কদম্ব বৃক্ষ ছিল। উহার নিম্নমুখী একটি ডাল ধারণ করিয়া আমি আত্মরক্ষা করিতে লাগিলাম। ২/১ মিনিট যাইতে না যাইতে চতুর্দ্দিকের জমি ফাটিতে লাগিল এবং ভূগর্ভ হইতে উচ্চসিত হইয়া জলধারা উর্দ্ধমুখে উঠতে লাগিল । দেখিতে দেখিতে বন্যার জলে রাজপথ ও চতুর্দ্দিকের স্থান জলমগ্ন হইয়া গেল প্রবল স্রোত বহিতে লাগিল। যেখানে জমি ফাটিতেছে সেইখান হইতে সরিয়া অন্য খানে যাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। ২/৪ মিনিটের মধ্যে জল হাটুর উপর পর্যন্ত উঠিল । তখন মনে হইল ইহা কেয়ামত ব্যতীত আর কিছুই নহে। এই সময় কে কোথায় কি অবস্থায় আছে কে কাহাকে দেখে। আমরা তওবা করিতে লাগিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে কলমা জপিতে রত রহিলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটি বুদ্ধি জাগিল। সঙ্গের বন্ধু মৌলভী ছাআদ উদ্দীন ছাহেবকে বলিলাম পাতাল দেশ হইতে পানি যে রুপ প্রবল বেগে উঠিতেছে তাহাতে জীবন রক্ষা পাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নাই। যথা সম্ভব চেষ্টা অবশ্যই করিতে হইবে । তখন পানি আমাদের কোমর পর্যন্ত হইয়াছে।

রৌমারিতে ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট গর্ত। ১৮৯৭ সাল। সার্ভে অব ইন্ডিয়া অফিস। সুত্র: সুত্র: আর ডি ওল্ডহ্যাম মেমোয়ার্স

কাছারির মাঠের উত্তরদিকে হাইস্কুলের উত্তর পাশে Scrinc ছাহেব রংপুর ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর থাকাকালীন পাহাড়ের আকার বিশিষ্ট একটি উচ্চ মৃত্তিকা স্তূপ স্তাপন করিয়াছিলেন।আমি বলিলাম সেই পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য আমাদের ধাবিত হওয়া উচিত। এই বলিয়া এক কোমর ও এক বুক পানি ভাঙ্গিয়া ঐ দিকে যাইতে লাগিলাম।কিন্তু স্থানে স্থানে  জমি ফাটিয়া গিয়াছে বলিয়া এক এক বার ফাটলের গর্ত্তে পড়িয়া হাবু ডুবু খাইতে লাগিলাম। আমরা পাহাড়টির দিকে অর্ধপথ যাইতে না যাইতেই ভূমির কম্পন ও জলোচ্ছাস বন্ধ হইয়া গেল। ৪/৫ মিনিটের মধ্যে জলা গড়াইয়া প্রবল বেগে নিম্নাভিমুখে সরিয়া যাইতে লাগিল। জল কমিতেছে দেখিয়া আমরা কাছারীর সম্মুখস্থ পুকুরের পাড়ে থামিয়া গেলাম। ১০/২০ মিনিটের মধ্যে পানি শুকাইয়া গেল। আমরা ভাবিলাম ইহা বোধ হয় কেয়ামত নহে । বাঁচিবার আশা আছে। কিন্তু দোয়া দোরুদ পুরাদমে চলিতে লাগিল। ইহার পর বন্ধু মৌলভী ছাহেবকে লইয়া আমি আমাদের ছাগলের আড্ডার মুনশী কেরামতকে দেখিবার জন্য গেলাম। তাঁহাকে জীবিত দেখিয়া  এবং তিনিও আমাদিগকে জীবিত দেখিয়া উভয়পক্ষ আনন্দ প্রকাশ করিলাম। তৎপর অন্যান্য বন্ধুদের খবর লইবার জন্য বাসায় বাসায় ঘুরিতে লাগিলাম। পাকা দালান অধিকাংশ ভূমিস্মাৎ হইয়া গিয়াছে। যাহা দন্ডায়মান ছিল তাহার  দেওয়ালে ফাটল ধরিয়া ছিল। মুনশী পাড়ায় কোন লোক মারা যাওয়া খবর পাওয়া যায় নাই। অনেকে আহত হইয়াছিল। আমরা বাজারের দিকে ধাবিত হইলাম।বাজারের নিকট একটি দ্বিতল বাড়ি ভূমিস্মাৎ হইয়া ১০/১২ জন লোক চাপা পড়িয়াছে জানিতে পারিয়া সেই দিকে ছুটিলাম। ২/৪জন লোককে হতাহত অবস্থায় তখন বাহির করা ইহয়াছিল। অবশিষ্ট লোক ইষ্টক চাপা ছিল। এই রুপে আরও বহু বাড়ি পড়িয়া গিয়া  অনেকে হতাহত হইয়াছিল। তাজহাটের মহারাজা গোবিন্দ লাল আহত হইয়াছেন বলিয়া সংবাদ পাইলাম। তাহার প্রাসাদের অনেক লোক হতাহত হ্য়াছিল। রাজবাড়ীও ধ্বংস হইয়া গিয়াছিল। ভূমিকম্পের ফলে রংপুর জেলার বহু বিল খাল ও নিম্নভূমি উচ্চভূমিতে ও উচ্চভূমি খাল বিল নিম্নভূমিতে পরিণত হইয়াছিল। কত লোক হতাহত হইয়াছিল তাহার ঠিক সংখ্যা অবগত হওয়া তখন দুঃসাধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। কোর্ট কাচারি স্কুল অর্থাৎ পাকা দালান মাত্র চুরমার হইয়া গিয়াছিল। সকলের মধ্যে হাহাকার সকলেই বিপন্ন।

এই ভূমিকম্পের দিবস আমাদের অনেকগুলি ছাগল কোথায় যে কিভাবে নষ্ট ও অপহৃত হইয়া গেল তাহার কোন খোঁজ মিলিল না। আমরা যখন হইতে এই ব্যবসায় হাত দিয়াছি তখন হইতে পদে পদে বাধা পাইতে লাগিলাম। মাত্র দুইমাসের মধ্যে আমাদের ছাগী সকল অনেকগুলো বাচ্চা দিয়াছিল। কোনটি মারা গেল, কোনটার চক্ষে ব্যারাম হল। এইভাবে আমাদের ছাগল সংখ্যা তিন ভাগের দুই ভাগ নষ্ট হইয়া গেল। এই সময় আমরা স্থির করিলাম অদৃষ্ট আমাদের প্রতিকূল। এই ব্যবসা যেন খোদার অভিপ্রেত নহে। যে ছাগুলগুলি ছিল তাহার অধিকাংশের চক্ষে পীড়া সংক্রমিত হইয়া পড়িল। কসাইয়ের আশ্রয় লইলাম। তাহারা সিকি মূল্যেও লইতে রাজী হয় না। ফলতঃ ২/৩ মাসের মধ্যে আমাদের ছাগল কোম্পানী করার সাধ মিটিয়া গেল। নিরুপায় হইয়া অবশিষ্ট ছাগলগুলিকে  এদিক সেদিক করিয়া হস্তান্তর করা হইল।জনপ্রতি ২৫/৩০ টাকা লোকসান দিলাম। এই কয়েক মাস ছাগল ক্রয়ে ও সেগুলির প্রতি যত্ন লইতে আমাকে ও পণ্ডিত সাহেবকে অনেক কষ্ট করিতে হইয়াছিল। সেই অকৃতকাযতার সময় হইতে এই যাবৎ (১৯৩১) পশু পালনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা কিছুমাত্র হ্রাসপ্রাপ্ত হয় নাই। এই শেষ বয়সেও দেয়াঙ্গের পাহাড়ের যেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা এছলাম মিশন ট্রেনিং কলেজ স্থাপনের সংকল্প পোষণ করিতেছি সেই পাহাড়ে কলেজ স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ডেইর ফার্ম করার বাসনা অত্যন্ত প্রবল আছে।

সুত্র: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী, আত্মজীবন, সংগ্রহ-ভূমিকা-সম্পাদনা শামসুজ্জামান খান, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০০৪।