প্রীতিলতার ঘড়ি

নিবেদিতা নাগ

১৯৩২ সালের একটি ঘটনা আমার এখনও খুব স্পষ্ট মনে পড়ে।কোনো একটি ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম। সেজকাকা ( প্রমোদরঞ্জন চৌধুরী)-র সঙ্গে এক টেবিলে বসে পড়াশুনা করছিলাম। সেজকাকা তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমাকে অঙ্ক করায় সাহায্য করতেন। হঠাৎ হারিকেনের পাশে রাখা ছোট একটা মেয়েদের হাতঘড়ি আমার চোখে পড়ল। তখনকার দিনে এখনকার মতো ঘরে ঘরে মেয়েদের হাতঘড়ির দেখা পাওয়া যেতনা। আমি সেজকাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম ঘড়িটা কার? সেজকা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তা জেনে তোর কি হবে?” আমি জেদ ধরলাম বলতে হবে। সেজকা বললেন, “তুই কি তার মত হতে পারবি?” আমি বললাম, “ তিনি কি রকম ছিলেন বল, নিশ্চয় হতে পারব।”

“তুই কি তার মত পান্তা ভাত খেতে পারবি? শুটকি মাছ খেতে পারবি, রাত জেগে দেশের কাজ করতে পারবি?”

আমার তখন জেদ চেপে গিয়েছিল, নিশ্চয়ই পারব। সশস্ত্র বিপ্লবীদের প্রভাবে তখন অনেক মহিলা যোগ দিয়েছিলেন।ইন্দুমতী সিংহ, বীণাদাস , শান্তি , সুনীতি ‘লীলা রায় সংঘের’ পথিকৃৎ ছিলেন।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ( ১৯১১-১৯৩২)

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি যে, ইতোমধ্যে সেজ কাকা পাড়ায় আমাদের বয়সী ছেলেময়েদের সন্ধ্যের পর আমাদের বাড়ীর মস্ত বড় উঠোনটায় জড়ো করতেন। লাঠি খেলা, ছোরা খেলা, সাইকেল চড়া ইত্যাদি শেখাতেন। সবাইকে বলতেন, “দেশকে স্বাধীন করতে হবে। ইংরেজকে তাড়ানো জন্য আমাদের এসব শিখে রাখা দরকার।” তখন আমরা জানতামই না সেজকা কোন দলের কর্মী ছিলেন।

যে যাই হোক এবার ঘড়িটার প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি।সেজকাকা বলেন যে ঘড়িটা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের। আমি চমকে গেলাম। জানতাম মাত্র কিছুদিন আগে চিটাগাং ইউরোপীয়না ক্লাব আক্রমন করতে গিয়ে প্রীতিদি নিহত হয়েছেন। সেজকাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ তুমি কি করে এ ঘড়ি পেলে?”

পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাব ভবনে সংযুক্ত স্মৃতিফলক। বর্তমানে এই ভবনটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করছে।

সেজকা বললেন, পার্টি থেকে আমাকে বলা হয়েছিল পাহাড়ের ওপরে থাকা ইউরোপীয়ান ক্লাবটিকে বিপ্লবীরা আক্রমণ করবে। বেশি রাত্রি পর্যন্ত সাহেবেরা ওই ক্লাবঘরে  নানারকম ফূর্তি করার জন্যে জড়ো হতো। বিরোধীরা ঠিক করেন ক্লাবে খোলা  জানালার বাইরে থেকে তাঁরা গুলি করবেন।  প্রীতিদি জোর দাবি তোলেন যে তিনিও আক্রমণকারীদের সঙ্গে থাকবেন। সাহেবরা যখন প্রায় মাতাল অবস্থায় তথন বিপ্লবীরা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। বেশ কিছু ব্রিটিশ নাগরিক আহত ও নিহত হয়। বিপ্লবীরা এবং ব্রিটিশ বাহিনী উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে প্রীতিদি আহত হন। ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনায় তিনি নাকি পটাশিয়াম সায়নাইড ব্যবহার করেছিলেন।

প্রীতিদি কোন মতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসেন এবং উপুড় হয়ে পড়ে থাকেন। তাঁর পরনে ছিল ছেলেদের মতো পোষাক। খাকি রঙ্গের প্যান্ট শার্ট। দেখলে একটি ছেলের মৃতদেহ বলেই মনে হবে। এই অভিযানে তিনি সম্পূর্ণভাবে পুরুষের সাজে সজ্জিত ছিলেন।

পার্টি থেকে সেজকার ওপর দায়িত্ব ছিল ক্লাব আক্রান্ত হয়েছে কিনা এবং কেউ নিহত ও আহত হয়েছিল কিনা তা দেখে আসার জন্য। ভোর চারটের সময় একটি মোটর গাড়ি চেপে চট্টগ্রাম শহরের দিকে আসার সময় সেজকা দেখতে পান যে খাকি পোষাক পড়া একজন লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কোন একজন বিপ্লবী আহত হয়েছেন ভেবে কাছে যেতেই কাকা দেখেন দেহটি মৃত প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের। তিনি তক্ষুণি মোটর গাড়ির চালককে বলেন চলুন আমরা একে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাই। চালক চিলেন বয়ষ্ক মানুষ। তিনি বললেন, ‘ এই দেহ নিয়ে যাওয়া খুব বিপজ্জনক কাজ হবে’। কাজেই সেজকা মৃতদেহের হাত থেকে ঘড়িটা খুলে নিয়ে লুকিয়ে রাখেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রীতিদির শেষ চিহ্নটুকু তার সাথে রাখা। পাহাড়ের মোড় ঘুরতেই দেখা গেল দলে দলে সওয়ার ব্রিটিশ সৈন্যরা ইউরোপীয়ান ক্লাবের দিকে এগিয়ে আসছে। হল্ট হল্ট বলে সজোরে চিৎকার করে কাকার গাড়িটিকে ওরা থামিয়ে দিল। কাকা ও গাড়ির চালককে জোর করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিল এবং চড় চাপড় মেরে জিজ্ঞাসা করল, “ কোথা থেকে তোমরা আসছ?” “আমরা খুব ভোরে সমুদ্র স্নানে গিয়েছিলাম সেখান থেকেই ফিরছি।” গাড়িতে পরিকল্পনামতো কিছু ভেজা ধুতি , গামছা রাখা ছিল। সৈন্যরা মারধর করে সেজকাদের ছেড়ে দিল বটে কিন্তু তার হাতে একটি লাল কার্ড ধরিয়ে দিল।

শহরে যারা বাস করত সে সময় ব্রিটিশ সরকার ২০ থেকে ৪০ বৎসর বয়ষ্ক ছেলেদের একটা করে কার্ড দিত, সেগুলি হল সাদা, সবুজ, লাল। সেই কার্ডগুলিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, বাবার নাম উল্লেখ থাকত। যে কোনো সন্দেহের তালিকায় থাকত না, তার জন্য সাদা কার্ড, কিছুটা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে সবুজ কার্ড এবং পুরোপুরি সন্দেহভাজন ব্যক্তির প্রাপ্য ছিল লাল কার্ড।

নিবেদিতা নাগ ( ১৯১৮-২০১৩) ব্রিটিশ-বিরোধি বিপ্লবী, কমিউনিষ্ট নেত্রী, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।

সুত্র: নিবেদিতা নাগ, ঢাকা থেকে কলকাতা , আলোচনা চক্র, কলকাতা, ২০১৮ ( প্রথম প্রকাশ)।