মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন
সে যুগে [১৯১৪-১৫] আমাদের মুসলমান সমাজে ভারি বই বা পত্রপত্রিকা দেখা যেত না। মুসলমানদের কোনো প্রকাশনালয় বা লাইব্রেরিও আমাদের সে অঞ্চলে [চাঁদপুরে] ছিল না। এই অভাবের কথা বারবার আমার মনে পড়তো। মাথায় বুদ্ধি এলো, এখানে একটি লাইব্রেরি স্থাপন করা যাক। কলকাতা থেকে ভালো ভালো বইপত্র এনে বিক্রি করলে সাহিত্যের প্রচার হবে। এর জন্য তখন মূলধনের অভাব আমার ছিল না। তাই একটি লাইব্রেরি স্থাপন করে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির [মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ব্রিটিশ ভারতের স্বনামধন্য ওরিয়েন্টাল ইন্সিউরেন্স কোম্পানীর প্রথম মুসলিম এজেন্ট ছিলেন] নামের অনুকরণে নাম রাখলাম ‘ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি’। কিন্তু এই লাইব্রেরির পরিচালনা করা যে কত কঠিন কাজ, তরুণ মনে সে চিন্তার উদয় হয়নি। একটা আকাঙক্ষা ও উদ্দীপনাই এর মুলে কাজ করেছিল।
এরপর কলকাতা রওনা হলাম ভালো ভালো বই কিনে এনে লাইব্রেরি সাজাবার জন্য। সারা কলকাতা ঘুরেও মুসলমানদের প্রকাশিত তেমন ভালো বইপত্রের সন্ধান পেলামনা। প্রথমেই গিয়েছিলাম বিখ্যাত বাংলা গ্রন্থ প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স এর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের দোকানে। বিরাট বই এর দোকান কিন্তু অনুসন্ধানে জানলাম, মুসলমান লেখকদের কোনো বই পুস্তক তারা প্রকাশের জন্য পান নি। একজন বললেন: কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে শেখ মনিরুদ্দিন এন্ড সন্স নামে একটি বড় পুস্তকের দোকান আছে, সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান করুন।
শেখ মনিরুদ্দীন এন্ড সন্সের দোকানে এলাম। তাঁদেরকে আমার উদ্দেশ্যের কথা জানালাম। বললাম: চাঁদপুরে একটি লাইব্রেরি স্থাপন করেছি।আমার ইচ্ছা মুসলমান লেখকদের ভালো ভালো বই নিয়ে বিক্রয় করবো।দোকানের ম্যানেজার বললেন: আপনি যে ধরণের বইপত্র চাচ্ছেন , তা পাবেন না। কারণ মুসলমান সমাজে গল্প-উপন্যাসের বই প্রকাশিত হয়নি। আমরা প্রধনাত হিন্দু সাহিত্যিকদের লেখা গল্প উপন্যাস এবং বেশির ভাগ স্কুল পাঠ্য বই বিক্রি করে থাকি। মুসলমানদের পুঁথি সাহিত্যই আজকাল আমাদের সমাজে বেশী বিক্রি হয়।নিয়মিত চালু পত্র পত্রিকা বলতেও মুসলমানদের তেমন কিছু নেই।
তিনি আমাকে স্কুল পাঠ্য বই নিয়ে লাইব্রেরি চালাতে উপদেশ দিলেন। কিন্তু তাঁর এ প্রস্তাব আমার মনপূত হলো না। সাহিত্য সংস্কৃতিমূলক বইপত্র প্রচার করাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য।
সেখান থেকে নিরাশ হয়ে চাঁদপুর রোডে গিয়ে দেখি সারি সারি পুঁথির দোকান। সুদৃশ্য চামড়ার বাঁধাই , সোনার জলে নাম লেখা বৃহৎ আকারের অনেক পুঁথি সেখানে দেখলাম। দামে সস্তা ও ক্রেতার ভিড়ও যথেষ্ট।
এক দোকানের মালিক আমাকে বললেন: নাম করা কতকগুলো পুঁথি আছে , সেগুলো আপনার লাইব্রেরিতে রাখলে গ্রামের লোকেরা কিনবার জন্য ভিড় করবে। আমাদের অধিকাংশ পুঁথি ক্রেতাই পল্লী গ্রামের। তার কথামত কতকগুলো পুঁথির অর্ডার দিয়ে রেল পার্শেলে পাঠাতে বললাম।এর পর আবার শেখ মনিরুদ্দীন এন্ড সন্স এর দোকানে ফিরে এলাম। তাঁদের উপদেশ মতো প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের নামকরা লেখকদের কতকগুলো বই ক্রয় করলাম। যে ধরণের বইপত্র পাবো বলে কলকাতা গিয়েছিলাম, তা না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম।
চাঁদপুর রোডের চামড়ার বাঁধাই বড় বড় পুঁথিগুলো তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে গেল। কিন্তু অন্যান্য সাহিত্য, এমনকি সুলভমূল্যের গ্রন্থাবলিও বিশেষ বিক্রি হলো না। তবে বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুল পাঠ্যবই এর বিক্রয় ছিল যথেষ্ট।
লাইব্রেরি করে অনেক টাকা লোকসান দিলাম।ক্ষতি স্বীকার করেও প্রায় তিন বছর এটা টিকিয়ে রেখেছিলাম । লাইব্রেরির ম্যানেজারের অযোগ্যতা ও সততার অভাবে অনেকে মূল্য পরিশোধ করেননি। আমি বই-পত্র ভালোবাসতাম, সে কারণে লোকসান হওয়া স্বত্ত্বেও সহজে লাইব্রেরি বন্ধ করিনি। লাইব্রেরি করে আর্থিক ক্ষতি যথেষ্ট হলেও এই ব্যবসায়ে অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছিল অনেক।
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বিখ্যাত সওগাত পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।
সুত্র: মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, সওগাত প্রকাশের নেপথ্যে স্মৃতিকথা , মাওলা ব্রাদার্স সংস্করণ, ঢাকা, ২০১৭।