রচনাঃ এডভোকেট হারুন অর রশীদ বেপারী
পাঠোদ্ধার ও টীকাঃ তাহমিদাল জামি
ভূমিকা
আমাদের হাতে উপস্থিত ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২৬ চৈত্র তারিখে সম্পাদিত একটি কাবিননামা। বেশ বিস্তারিত এই কাবিনে ১০০ বছর আগে বাঙালি মুসলমান সমাজে বিয়েশাদির কিছু কৌতূহল জাগানিয়া বিষয়ের অবতারণা পাওয়া যায়। কালিয়াকৈর নিবাসী মাহাছুমা খাতুন এবং টুমায় নিবাসী আবদুচ্ছোবহানের বিয়ের কাবিননামা এটি। কাবিননামা মূলত একটা চুক্তি, যাতে স্ত্রী-পণ এবং কিছু শর্ত নিয়ে বরপক্ষ আর কনেপক্ষ সম্মতি জ্ঞাপন করে। দলিলের পাঠ আমরা নিচে দিলাম। আলোচনা ও টীকা পরে সংযোজিত হল।
দলিলের পাঠ
[সিল]
… stamp duty under the Indian Stamp Act 1899, S..
Date 1, No. 58 …
… paid …
শ্রীমতী মাহাছুমা [মাসুমা] খাতুন, পিতা শ্রী এলাই বখস(,) সাকীম কালীয়কর(,) থানে …(,) জাতী মুসলমান(,) ব্যবসা গৃহস্থ কাবিন গার্হস্থ্য স্থানে লিখিতং শ্রী আবদুচ্ছোবহান,পিতা শ্রী আবদুল (,) সাকীম টুমায় (,) থানে … (,) জাতী ঐ(,) ব্যবসা ঐ (,) কাবিন দাতা ফর্দ (?) দেএন মোহরের কাবীন নামা পত্র মিদং কার্যঞ্চাগে আমি আমার আপন খুসী খোসরাজী রাগবতে বহাল তবীঅতে সেচ্ছা পূর্বক কালীয়কর নিবাসী মৃত আসাবাদ্দী মাজির (মীয়াজি?) পুত্র শ্রী মোক্রম (মুকাররম) আলী ও টুমায় নিবাসী মৃত সেক আলী মীআজীর পুত্র … সেখ মীঞা কতিপয় সাক্ষীগণের সাক্ষ্যতায় হাজীরাণ মজলিশে আপনী বালেগা থাকা বশতঃ আপনীর খোদ এজেণ মতে আপনীর পিতা ছাহেবের ওকালতিতে ম ৩০০ \ তিনশত টাকা … মোহরাণা ধার্য করিয়া উহা স্বীকৃত করতঃ আপনীকে বিবাহ করিয়া আমার আপন জজিয়তে আনিলাম (।) উল্লেখিত মোহরানা মবলগ মজকুর মধ্যে স্বর্ণ রৌপ্যালঙ্কার আদি ম ৬০\ ষাইট টাকার অলঙ্কার, আপনীর পিতা ছাহেবের মারফত আপনীকে নগদ বুজাইয়া দিলাম (।)
উক্ত অলঙ্কার অদ্য হইতে আপনীর এক্তেয়ার করিয়া দিলাম জাহা আমি কোন রূপ অত্যাচার কিম্বা মন্দকার্যের দ্বারা আত্মসাৎ করিতে পারবনা। ছিলভর (সিলভার) ইত্যাদির দ্বারা উক্ত অলঙ্কারের পরিবর্তন ঘটাইতে পারিবনা কিম্বা কোন প্রকার খোয়ান গেলে তাহা আমি বিনা ওজরে ফুরণ (পূরণ) করিয়া দিব না দিলে সমুদয় অলঙ্কারের দাবীতে (?) নালেশ দাএর করতঃ ডিক্রী জারিক্রমে আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তী নিলাম বিক্রীর দ্বারা আদায় করিয়া লইতে তৎকালীন আমি কি আমার ওয়ারিশান কোন প্রকার ওজর আপত্তী শ্রোত যোগ্য হইবেক না (।) তদ্বারা আদায় না হইলে আমার শরীর তাহার দাই (দায়ী) রহিবেক (।)
অলঙ্কার বাদ অবশিষ্ট ম ২৪০ \টাকার মধ্যে ম ১৪০ \ টাকা আপনী স্বয়ং কিম্বা পিতামাতা অথবা আপনীর কার্যমতো (?) যে ব্যক্তি মুরব্বি হইয়া ওপর (?) করান তৎকালীন আপনী আমার জাজীয়তে হাজির থাকা না থাকা কোন প্রকার আপত্তী উত্থাপন না করিয়া অত্র কাবিনের পৃষ্ঠে ওয়াশিল লিখাইয়া পরিশোধ করিব। তদ্ভিন্ন কোন রশিদ … দ্বারা উক্ত ব্যয় … (?) লইবনা (।) অবশিষ্ট ম ১০০\ একশত টাকা আপনী ও আমার বিবাহ কাএম থাকা পর্যন্ত ক্রমান্বয় পরিশোধ করিতে থাকিব (।) যখন যে টাকা দেই অত্র কাবীনের পৃষ্ঠে উশুল ভিন্ন উশুলের … পাইবনা (।) অত্র কাবীন আপনীর পিত্রালয় হইতে কোনরূপ ছল চক্র করিয়া নিয়া মোহরের টাকা উশুল দিতে কিম্বা আপনীকে আপনীর পিতামাতার অসাক্ষাতে বাধ্যকতা করিয়া মোহরের টাকা রেহাই বাদ দিতে তাহা আইনত গ্রাহ্য হইবেক না এবং প্রতিজ্ঞায় নিম্নলিখিত সত্য (শর্ত) সমূহ স্বীকৃত পূর্বক লিখিয়া দিতেছি তদাকার আচরণ করিব কস্মিণ কালেও ভিন্ন আচরণ করিব না।
১ম সত্য এই যে আপনীকে আমার আপন জজিয়তে আনিয়া পর্দা পুসিদা মতে রক্ষণাবেক্ষণ পূর্বক স্ত্রী পুরুষের আচার ব্যবহার পালন (?)করিতে থাকিব (।) বেসরা বেপর্দা লএক (?) কর্মে হুকুম করিবনা (।) আমার বাটীতে কোন কারণ বশত খানে তাল্লাসীর জন্য হুকুম সহকারে কোন কর্মচারি উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই আপনীকে আপনীর পিত্রালয় নিয়া রাখিব বারবার এইরূপ কার্য হইলে আপনী সেস্থানে বসতি বাস করিতে ইচ্ছা করিলে তথায় নিজ ব্যয় ভূষণে উপযুক্ত বাসগৃহ প্রস্তুত করিয়া দিয়া নিম্ন লিখিত হারে খোরপোষ প্রদানে সক্ষম থাকিয়া স্ত্রীপুরুষের আচার ব্যবহারে দিন যাপন করিতেথাকিব। দিনরাত ঝগড়া ফ্যছাদ কিম্বা গালিগালাজ কি কোন প্রকার মাইর পিট করিতে পারব না করিলে দণ্ড বিধি আইনের বিধি মতে সাস্তি প্রাপ্ত হইব(।) সুখাসুখ কার্যোপলক্ষ্যে পিতৃ মাতৃ কিম্বা কুটুম্ব বাড়ি যাইতে বারণ করিব না (।) যাওয়া (আ)বশ্যক হইলে যাইবেন (।) ব্যয় ভূষণে পর্দা পুসীদা মতে তথায় পহুচাইব ও আনীব কস্মিন কালে তদন্যথাচরণ করিব না করিলে নিজ ক্ষমতায় যাইতে পারবেন এহেতু রাগান্বিত হইয়া গালিগালাজ কিম্বা মাইরপিট করিলে দণ্ডবিধি আইনের বিধান মতে সাস্তি প্রাপ্ত হইয়া থাকিব।
২য় সত্য এই যে আপনীকে (ব্যতীত) ২য় নেকাহ সাদি করিতে পারিব না এবং অন্য কাহাকে উপস্ত্রী রাখিয়া আপনিতে প্রণয় হইতে বিরত হইবনা (।) যদি তাহা করি তাহা হইলে সমুদয় মোহরানার দাবিতে নালিশ দাএর করিয়া ডিক্রি জারি এবং আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নিলাম বিক্রয় দ্বারা করিয়া লইতে পারিবেন এবং নিজ ক্ষমতায় আমার জজিয়ত বর্জিত করিয়া স্বাধীন ভাব অবলম্বন করিতে পারিবেন (।) আর যদি আপনী (রোগা)ক্রান্ত হয়েন নিজ ব্যয় ভূষণে উপযুক্ত চিকিৎসক ধরাইয়া চিকিৎসা করাইব না করিলে নিজ ক্ষমতায় পিত্রালয় যাইয়া আরোগ্য লাভ (করিবেন।) যে ব্যয় পড়িবে তাহা এবং নিম্ন হারে খোরপোষের দাবিতে নালিশ দাএর করতঃ ডিক্রী জারিক্রমে আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির দ্বারা আদায় করিয়া লইতে পারিবেন আর যদি একান্ত আমার ২য় (নীকাহ?) করা (আ)বশ্যক হয় তৎকালীন আপনীর সমুদয় মোহরের (ব্যয়) শোধ করতঃ আপনীর অনুমতি গ্রহণে করিব (।) ইহা না করিয়া নিজ ক্ষমতায় করিলে ২য় নেকাহ স্ত্রী আমার জজিয়ত ১/২/৩ তালাক প্রাপ্ত হইবেক (।)
আর যদি আপনির সহিত আমার পরিবার বর্গর সহিত বনিবনা না হয় তৎকালীন আপনি যেস্থানে বশত বাস করিতে ইচ্ছা করেন তথায় আমার নিজ ব্যয় ভূষণে উপযুক্ত বাসগৃহ প্রস্তুত করিয়া দিয়া মাসীক ম ৬\ ছয় টাকা হারে খোরপোষ প্রদানে সক্ষম থাকিয়া স্ত্রী পুরুষের আচার ব্যবহারে কাল যাপন করিতে থাকিব (।) ইহা না করিলে আপনীর উপর স্ত্রী সত্যের দায় দাবি করিতে পারিব না (।)
৩য় সত্য এই যে আপনীর অনুমতী ভিন্ন দূর দেশ পরবাস যাইতে পারিবনা একান্ত যাওয়া (আ)বশ্যক হইলে অগ্রে উল্লেখিত হবার ৭ মাসের খোরপোষ প্রসাদ (?) দিয়া যাইব (।) ৩ মাসের ঊর্ধ্বকাল পরবাস করিতে পারিব না (।) ম্যায়াদ অতিরিক্ত পরবাস করিয়া আপনীর খোরপোষের কষ্ট জন্মাইলে ৪র্থ সত্যের মর্মানুযাই (মর্ম অনুযায়ী) সত্যের ফল প্রাপ্ত হইবেন এবং উল্লাখীত হারে খোরপোষের দাবীতে থানের দাএর করিয়া ডিক্রী জারিক্রমে আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তী নিলাম বিক্রয় দ্বারা আদায় করিয়া লইতে পারিবেন তদাভাবে আমার শরীর দাই (দায়ী) থাকিবে (।)
৪র্থ সত্য এই যে আমি দুরদেশ পরবাস যাইয়া অনুদ্দেশ হই কি … কারাবাসী হই কিম্বা উন্মত্ত জ্ঞানশূন্য হই কি পুরুষত্ব রহিত হইয়া স্ত্রী পুরুষের আচার ব্যবহারে অক্ষম হই কিম্বা উৎকট রোগ প্রাপ্ত হইয়া আপনীর ভরণ পোষণ প্রদানে ত্রুটী হ কিম্বা উপরোক্ত সত্য হতে (?) মধ্যে কোন এক সত্য লঙ্গন (লংঘন) করি এইসকল লক্ষণ আমার উপর বর্তালে আপনী আমার জন্য ১ বৎসর কাল সাবকাশ (?) থাকিয়া (?) আপনীর … আমার জজিয়ত হইতে ত্যাগ করার ক্ষমতা আছে (।) এই ক্ষমতা আপনীকে অর্পণ করিলাম (।) আপনী এই ক্ষমতার বলে আমার জজিয়ত হইতে ১।২।৩ তালাক ছালাছা প্রাপ্ত হইয়া স্বীয় শরীর মুক্তিক্রমে অন্যত্র নেকাহ শাদি বসিতে (পারিবেন।) তৎকালীন আপনীর উপর স্ত্রী সত্যের দায় দাবি ও জজিয়তের দায় দাবি সর্বাদালতে বাতিল ও নামঞ্জুর হইবেন অত্র (?) ভঙ্গ করিয়া কোন প্রকার দাবিদাওয়া করিলে বঞ্চনার অপরাধে সাস্তিপ্রাপ্ত হইব (।) এতদর্থে দেএন মোহরের কাবিন নামা পত্র লিখীত (?) দিলাম ইতি … ১৩২২ সন তারিখ ২৬শ চৈত্র অত্র দলিলের সমস্ত বিবরণ পাঠ করিয়া দলিলদাতাকে শুনাইলাম।
শ্রী আবদুল আকীজ …
লিখক
ই সাক্ষ্য
শ্রী বাদশা মিয়া
সাং টুমচর (টুমায়?)
৬০
খোরপোষ মাসিক … টাকা হারে বার্ষিক ম ৭২
মোট ৩৭২
লিখক শ্রী আবদুল আকিজ … সাং টুমায়
[নিচে বামপাশে] ই সাক্ষী (?)শ্রীহামিদুল্লা
সাং কালীয়কর
শ্রী এমরাত মালী
সাং টুমায়
শ্রী সেক সক…
সাং কালীয়কর
শ্রী … বেপারী
সাং কালী(য়)কর
টীকা
খোসরাজি – খুশি ও রাজি, স্বেচ্ছাসম্মতি; রাগবত – বাসনা বা ইচ্ছা;
মবলগ – পরিমাণ; মজকুর – উল্লিখিত;
মোহরানা – ইসলামি শাস্ত্রবিহিত স্ত্রী-পণ; খোরপোষ – ভরণপোষণ;
জজিয়ত – জুজিয়াত, স্ত্রীত্ব বা বৈবাহিক সম্পর্ক, الزوجية; ওয়ারিশান – উত্তরাধিকারীগণ;
ওয়াশিল/ উশুল – আদায়, পরিশোধিত;
তালাক ছালাছা – বিবাহ ভঙ্গের মন্ত্র বা পদক্ষেপের তিনদফায় সম্পূর্ণকরণ
আলোচনা
বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনায় বিবাহ ইত্যাদি আচারের প্রথার গুরুত্ব অনেক। হিন্দুসমাজের বিবাহ আচার ইত্যাদি নিয়ে অনেক বইপত্র আছে। কিন্তু মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক প্রমাণভিত্তিক লেখার কিছু অভাব রয়েছে। ইসলামের শাস্ত্রীয় নানা গ্রন্থ আছে বটে, কিন্তু সেগুলোতে মূলত বিধিবিধান বা নরমাটিভ আলোচনাই পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে বাঙালি মুসলমান সমাজে বিয়ে-শাদি আচারাদি কিভাবে আমল করা হত তার আন্দাজ পাওয়ার উপায় নাই। রাজরাজড়াদের বিয়েশাদি নিয়ে কিছু প্রমাণ সুলভ হলেও সমাজের মধ্যবিত্ত ও সাধারণের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানার সুযোগ সীমিত। সেই জানাশোনা করতে হলে সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দুর্লভ নানা পুরানা নথিপ্রমাণের খোঁজ করা দরকার। এগুলো সংগ্রহ, পর্যালোচনা ও প্রকাশ করা তাই জরুরি। সেক্ষেত্রে আমাদের উপরের কাবিননামাটি অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং। আমরা এই কাবিনে দেখতে পাই যে, কনের সুবিধা ও স্ত্রী-অধিকার কাবিন নামক এই বিবাহ দলিলের মূল বিষয় ছিল।
প্রথমেই দেখবেন, এই বিয়ে টি সম্ভবত বাল্যবিয়ে ছিল না। কনের প্রাপ্তবয়স্কতা এবং সম্মতি (এজেন) মুসলমানি বিবাহে আবশ্যক ছিল। দুই প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে এই বিয়েতে স্ত্রীর যেসব অধিকার উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে মোহরানা বা স্ত্রীপণ, যা স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকায় পরিশোধ্য। এই পণ একান্তভাবেই স্ত্রীর সম্পত্তি। স্বামী তা কোনক্রমেই আত্মসাৎ বা এড়িয়ে যাওয়ার অধিকার রাখেন না। সেইসাথে দিতে হবে খোরপোষ বা ভরণপোষণ, চিকিৎসা, ও বাসস্থান। স্ত্রীর শিক্ষার অধিকারটি অবশ্য এখানে উল্লিখিত হয় নাই। ঠিইক এই সময়টিতেই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) নারীশিক্ষা আন্দোলন নিয়ে অগ্রণী হয়েছিলেন। তবু সাধারণ নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ ছিল সীমিত। যা হোক, শিক্ষা বাদে স্ত্রীর বাকি মৌলিক অধিকারগুলো স্বামীকেই নিশ্চিত করতে হবে – এটাই এই দলিলে উল্লিখিত।
দ্বিতীয় অধিকারটি হল “স্ত্রী-পুরুষের আচার-ব্যবহার”। এর অর্থ হচ্ছে বৈবাহিক মেলামেশা। মৌলিক অধিকারের পর এল এই যৌগিক অধিকার। এই অধিকার ভারি গুরুত্বপূর্ণ জিনিশ। বিবাহে যে কেবল স্বামীই স্ত্রীর নারীসত্তার উপর দখলদার হন না, স্ত্রীও স্বামীর পুরুষসত্তার উপর অধিকার লাভ করেন, সেটা এই অধিকারে কবুল করা হয়েছে। একইসঙ্গে স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের ব্যাপারে আরোপ করা হয়েছে নানা শর্ত, যে সকল শর্ত পালন না করলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিবাহ স্বতই তালাক হয়ে যাবে।
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আচরণ যাচ্ছেতাই হতে পারবে না। স্বামী যদি কটূকথা বলেন কিংবা মারধোর করেন, সেটা যে আইনি অপরাধ হবে, এবং দণ্ডবিধি অনুসারে সাজাও হবে, সেকথা খোলাখুলি বলা হয়েছে। সেই আমলে পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই উচ্চারণ আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে।
স্ত্রী কেবল ব্যক্তিমানুষ নন, একজন সামাজিক মানুষও, ফলে তাঁর একটি ধর্মীয় বা নৈতিক সত্তাও থাকে। সেই সত্তার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এই দলিলে — বলা হয়েছে স্ত্রী যেন শরিয়তের বিধান যথা পর্দাপুশিদা মেনে চলতে পারেন সেই বিষয়ে স্বামীকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিয়ের মধ্য দিয়ে বাপের বাড়ির সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক চুকেবুকে যাবে এমন কোন কথা নেই। অর্থাৎ বিয়ের আগের স্ত্রীর সামাজিক সত্তাটিকে স্বীকার করা দরকার। স্ত্রী প্রয়োজনে বাবা-মা বা আত্মীয় বাড়িতে যেতে পারবেন, এই বক্তব্যের দ্বারা সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবার স্বামীর পরিবারের সাথে যে স্ত্রীর বনিবনা নাও হতে পারে, এবং না হলে তাঁকে আলাদা বাসা বানিয়ে রাখতে হবে, সে কথাও স্পষ্ট করে বলেছে দলিল। কিংবা যদি স্বামীর বিদ্যমান গৃহ স্ত্রীর জন্য অনুপযুক্ত হয়, তাহলে স্বামী তাকে আলাদা বাসা বানিয়ে দেবেন।
এই যে নানাবিধ অর্থনৈতিক, নৈতিক ও সামাজিক অধিকারের তালিকা, এগুলো স্বামী যদি লংঘন করেন, তাহলে তাঁকে শুধু মোহরানা পুরাপুরি শোধ করতে হবে তাই নয়, আদায় করতে না পারলে ডিক্রি জারি করে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে হলেও দেনা শোধ করতে হবে। তবু যদি শোধ না হয়, তবে স্বামীর শরীর পর্যন্ত দায়ী থাকবে। শরীর দায়ী থাকা বলতে, সম্ভবত দাবি মেটাতে স্বামীকে গতর খেটে হলেও প্রাপ্য শোধ করতে হবে। এই কথার মধ্যে সম্ভবত সেকালের ইনডেঞ্চারড শ্রমের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
লক্ষ্য করার বিষয় এই যে বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্ককে এখানে সামাজিক ও আইনি কাঠামোর অধীনে দেখা হয়েছে। বিয়েকে বা দাম্পত্যকে এখানে স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক আর্থ-সামাজিক দেনাপাওনা বা অধিকার চর্চা থেকে মোটেই পৃথক বা স্বাধীন করে দেখা হয় নি। “প্রণয়” কথাটি একবার এসেছে বটে, তবে তা প্রথাবৈধ ও প্রথাবিহিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের আবেগিক দিক হিসাবেই এসেছে।
কাবিনের দলিলটি মূলত স্ত্রীকে সম্ভাব্য নানা প্রকার বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করার কবচ হিসাবে কাজ করবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল। স্বামীর পক্ষে যত প্রকার অসদাচরণ বা অক্ষমতা সম্ভব, সেগুলো একে একে উল্লেখ করে তার প্রতিকার স্পষ্ট করা হয়েছে এখানে। অবশ্য এই যে এত সাতপাঁচ শর্ত উল্লেখ করা লাগল, তাতে স্বামীরা সেযুগে স্ত্রীদের অধিকার কিভাবে ক্ষুণ্ন করতে পারতেন, তারও একটা আলামত পাওয়া যায়। সেই অধিকার ক্ষুণ্নের মধ্যে ছিল স্ত্রীর অলঙ্কারে খাদ মেশানো থেকে শুরু করে মারপিট, কিংবা বিদেশে গিয়ে অনির্দিষ্টকাল গায়েব হয়ে থাকা।
সার্বিকভাবে এখানে স্ত্রী বা বিবাহিত নারীকে স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক, নৈতিক ও সামাজিক সত্তা হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে, যদিও সে যুগে তার সামাজিক অধস্তনতাও এখানে প্রকাশিত হয়েছে – কারণ স্বামী বা পিতাই তার অশরণের শরণ হিসাবে হাজির আছেন। আর আছেন আদালত বা রাষ্ট্র। স্বামী অর্থনৈতিক উপার্জনকারী এবং সামাজিকভাবে সক্রিয় সত্তা, আর স্ত্রী নির্ভরশীল। স্বামী প্রবাসে গমন করতে পারেন, যদিও স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে ও শর্তাধীনে। স্ত্রীর প্রবাসগমন স্বভাবতই প্রথাবদ্ধ বাঙালি মুসলমান সমাজে কোন বাস্তব সম্ভাবনা হিসাবে উপস্থাপিত হয় নি।
দলিলের ভাষা সরল ও সহজ। তবে যতিচিহ্নের অনুপস্থিতি, বানানে প্রাচীনতা বা অপ্রচলিত বা ত্রুটিপূর্ণ প্রয়োগ, ইত্যাদি লক্ষণীয়। আরবি-ফার্সি শব্দ যতটুকু আছে তাকে বাহুল্য বলা যায় না, সেইসাথে নানা তৎসম শব্দও আছে – এবং এই উভয় প্রকার শব্দ বা প্রকাশভঙ্গি দলিলটিকে ভাবগম্ভীর ও আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দান করতে প্রযুক্ত হয়েছে।