লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের সাক্ষাৎকার

লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের এই সাক্ষাৎকারটি ১৯৮৩ সালে নেওয়া হয়। মনসুরউদ্দীনের শান্তিনগরস্থ বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন আব্দুল মান্নাস সৈয়দ ও আবদুল মোহিত। সাক্ষাৎকারটি আবদুল মান্নাস সৈয়দ ও আবিদ আজাদ সম্পাদিত মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন স্মৃতি-এলবাম নামক গ্রন্থে ১৯৮৮ সালে ছাপা হয়।

প্র.       লোকগীতি সংগ্রহের উৎসাহ প্রথম আপনার কিভাবে জাগে?

উ.        ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত লালন ফকিরের কয়েকটি গান প্রকাশিত হয়েছিলো। সেই গানগুলি পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। তারপর রবীন্দ্রনাথের মতো মহান ব্যক্তিত্ব এই ধরনের সংগ্রহ-কাজ করেছেন ব’লে উৎসাহী হ’য়ে উঠলাম। আমাদের গ্রামের এক বৈরাগীর গান শুনতাম। আমার লোকসংগীতের প্রথম উৎসাহদাতা রবীন্দ্রনাথ আর নামহীন ঐ বৈরাগী। এ সময় আমি দেশের বাড়িতেই ছিলাম।

Mohammad Monsooruddin
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন

প্র.    আপনার সময়ের কথা কিছু বলুন।

উ.        আমরা ছিলাম খুব গরিব। শিলাইদহে বিরাহিমপুর পরগনার মাদার তলায় আমাদের এবং আমাদের গ্রামের অনেকের জমিজমা ছিলো। নদী সেসব জমি গ্রাস করে। ঠাকুর-পরিবারের জমিদারির অন্তর্গত ছিলো সে-সব। আমি যখন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে আই.এস.সি পড়তে যাই- ১৯২২-২৩ সালের দিকে- শুনলাম রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। এক ভদ্রলোক আমাকে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যান; সেই আমি প্রথম দেখি রবীন্দ্রনাথকে। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেখানে ছিলেন। তারপর ১৯২৬ সালে বি.এ. পাশ ক’রে কলকাতায় যাই। ঐ বছর পাবনায় ভীষণ দাঙ্গা হয়েছিলো। উঠি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 53 old Ballyganj 1st কি Second Lane- এর প্যাগোডা ধরনের বাড়িতে (শেষবার কলকাতায় গিয়ে বাড়িটা কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারিনি)। তখন আমার না আছে সুটকেস্, না লেপ-তোষক-একেবারে শূন্য, নিঃস্ব। তাঁরাই সেসব ব্যবস্থা করে দিলেন। শহীদ ও শাহেদ সোহরাওয়ার্দির চাচা আব্দুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দির পরামর্শে কলকাতা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভরতি হই। দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন সেখানকার অধ্যাপক। তিনি বাংলা সাহিত্য পড়াতেন ইংরেজিতে। একদিন এক কাণ্ড হয়েছিলো। ‘গৌরীদান’ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন তিনি। তিনি ব’লে ফেললেন, মুসলমান নবাব-বাদশারা হিন্দু মেয়ে পেলেই নিয়ে যেতেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার, এ রেফারেন্সটা কোথায় পেয়েছেন? শুনে তিনি তো ভীষণ রেগে উঠলেন-ক্লাসই নিলেন না সেদিন। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। সে বললো, তুমি খুব অসুবিধায় পড়বে। আমি ছিলাম পাবনার গাঁইয়া। বললাম, দরকার হ’লে দেশে ফিরে গিয়ে বাপ-দাদার মতো চাষবাস করবো। শেষ-পর্যন্ত দীনেশ সেনের স্নেহই পেয়েছিলাম। দীনেশ সেন বাংলা ডিপার্টমেন্ট থেকে লোকসাহিত্য বিষয়ক একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আহ্বান করেন। নাম ছিলো ‘স্যার আশুতোষ প্রাইজ’।তাতে অংশ নিয়ে বিজয়ী হলাম আমি আর ধীরেন মুখার্জি।

পঁচাত্তর টাকা করে এক-একজন পাই। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন টেররিস্ট আন্দোলনের গোপন এক হোতা, আমরা তখন জানতামই না, পরে টের পাই। প্রমথ চৌধুরী থাকতেন পাম অলিভ-এ আমাদের বাড়ির কাছেই। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়া-সাঁকো ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। রবীন্দ্রনাথের কাছে।

কারমাইকেল হোস্টেলে থাকতাম কিছু দিন। সে সময় আমরা ‘তরুন জামাত’ নামে একটি সংগঠন করেছিলাম। আমি ছিলাম প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি ছিলেন মীর্জা আলাউদ্দিন বে। সে সময় আমরা এক চমৎকার অনুষ্ঠান করেছিলাম, তাতে এসেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন গাঙ্গুলি, এস.ওয়াজেদ আলী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দীনেশচন্দ্র সেন, হুমায়ুন কবির প্রমুখ। ‘কারমাইকেল হোস্টেল ডিবেটিং সোসাইটি’রও প্রেসিডেন্ট ছিলাম আমি। মিস্ ফজিলাতুননেসার বিলেত যাত্রা উপলক্ষে সোসাইটির তরফ থেকে আমরা একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলাম। নজরুল ও কাজী মোতাহার হোসেন দুজনই ফজিলাতুননেসার প্রেমে পড়েছিলেন। সংবর্ধনার দিন আমি অবশ্য থাকতে পারিনি। যদ্দুর মনে পড়ে, হোস্টেলে ফিরে শুনেছিলাম নজরুল এসেছিলেন এবং গানও গেয়েছিলেন।

প্র.    আপনার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ “হারামণি”, “হারামণি”র লেখক হিশাবেই লোকে আপনাকে এক ডাকে চেনে, এই বই সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

উ.        আমার সংগৃহীত লোকগীতি পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিলো। এগুলো একত্রিত ক’রে ছাপতে দিই। করিম বক্স ব্রাদার্স বইটি ছাপে। আমার সাধ হয়, রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে এই বই-এর ভূমিকা লিখিয়ে নেবো। এই উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাই। শান্তিনিকেতন গেস্ট হাউজে উঠি। রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি তখন কবি অমিয় চক্রবর্তী। গিয়ে দেখি তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী বাংলা শিখছেন। তিনি আমাকে উপহার দিলেন অমিয় চক্রবর্তীর “খসড়া” বইটি।[এটি স্মৃতি-বিভ্রম। কেননা “খসড়া” বইটি বেরিয়েছে ১৯৩৮ খৃস্টাব্দে। বেগম চক্রবর্তী সম্ভবত তাঁকে দিয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা-পুস্তক “কবিতাবলী” বা “উপহার” এর কোনো একটি। অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব ছিলেন ১৯২৬-৩৩ সময়কালে – আবদুল মান্নান সৈয়দ] যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয় এবং আরজি পেশ করি। রবীন্দ্রনাথ তখন পৌষ সংক্রান্তির দিনে কি-একটা নাটক হবে, তাই নিয়ে ব্যস্ত। বললেন, আমার বাউল নিয়ে আমি পারছিনে, তুমি আর-এক বাউল নিয়ে  এলে হে? ঠিক আছে, এসেছো যখন, দুলাইন লিখে দেবো। আমি তাই নিয়েই খুশি। আমার সংগ্রহের তাড়াটি রবিন্দ্রনাথের কাছে দিয়ে আমি এ্যান্টি-রুমে গিয়ে বসলাম। এ্যান্টি-রুমে ব’সে আছি, বুক দুরুদুরু করছে, দোয়া-দরুদ পড়ছি-না জানি কি লিখে দেন। কিছুক্ষন পরে আমাকে ডেকে আমার নামটি লিখে দিতে বললেন একটি কাগজে।  আবার এসে এ্যান্টি-রুমে ব’সে বুক দুরুদুরু- করা অপেক্ষা। -এক্ষুণি হয়তো ডাকবেন- ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুক্ষণ পরে ডাকলেন। গিয়ে দেখি লম্বা লেখা- তিন স্লিপ। রবীন্দ্রনাথ বললেন, তুমি আমার দিনটাই নিয়ে গেলে। আমি তো মহাখুশি। অন্য সবাইকে দেখালাম। তাঁরাও বললেন, গুরুদেব প্রচুর প্রশস্তি লিখে দিয়েছেন আপনার। এই ভুমিকাটিই শিরোধার্য ক’রে “হারমণি” প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। এটি ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয়েছিলো। সেবার শান্তিনিকেতনে ওঁদের অনুরোধে ওমর খৈয়াম বিষয়ে একটি বক্তৃতাও দিয়েছিলাম।

পরে “হারামণি”-র অন্য একটি খণ্ডের জন্য আবার রবীন্দ্রনাথের সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তখন এত ব্যস্ত যে ভূমিকা লিখে দিতে পারেননি। তবু একেবারে বঞ্চিত করেননি। একটি আশীর্বাণী লিখে দিয়েছিলেন। ২৩ শে জুলাই ১৯৩৭ শালে লেখা এই আশীর্বাণীটি এইঃ ‘তোমার গ্রাম গীতি সংগ্রহের অধ্যবসায় সফলতা লাভ করুক এই আমি কামনা করি।’

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শেষ দেখা হয় আমার ১৯৪০-এর দিকে, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর সময়। রবীন্দ্রনাথ আমাকে চিনতে পারেন। বলেন, ‘তুমি লালন ফকিরের গান সংগ্রহ করেছো না?’ তাঁর শরীর তখন ভেঙ্গে গেছে একেবারে।

“হারামণি”-র জন্যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি বাউলের ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। প্রথম তিনি এঁকেছিলেন একটি বাউল- মাথায় তার চূড়া। কী-যে বোকামি করেছিলাম। ছবিটা আমার পছন্দ হয়নি, মাথার ঐ চূড়া। তখন যদি সেটা রেখে দিয়েই আরেকটা ছবি এঁকে দিতে বলতাম। একটা ছোট ছেলে যাচ্ছিলো বারান্দা দিয়ে, অবন ঠাকুর তাকে ডেকে ঐ মাথায় চূড়াঅলা ছবিটি দেখিয়ে জিগেশ করেছিলেন, কেমন হয়েছে রে? ছেলেটি শুধু বলেছিলো, বেড়ে! পরদিন অবন ঠাকুর আর-একটা বাউলের ছবি এঁকে দিয়েছিলেন, সেটিই “হারমণি”তে ব্যবহৃত হয়। এই ছবিটিও প্রকাশিত হয়েছিলো ‘প্রবাসী’-তে- আমারই একটি লেখার সঙ্গে। অরিজিনাল ছবিটা প্রবাসী থেকে হারিয়ে যায় আমারই নির্বুদ্ধিতায়-সম্ভবত কেউ গাপ করেছিলো।

“হারমণি” প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিলে। ‘স্টেট্স্ম্যান’, ‘এ্যাডভান্স্’, ‘লিবার্টি’ প্রভৃতি পত্রিকায় দীর্ঘ রিভিয়্যু বেরিয়েছিলো।পঁয়তাল্লিশ বছরের পরিসরে (১৯৩১-৭৬) “হারমণি”-র আটটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।

প্র.    নজরুল ইসলাম, জয়নুল আবেদীন ও জসিমউদ্দীনের সঙ্গে আপনার পরিচয় ও সান্নিধ্যের সংবাদ জানতে চাই।

 উ.      সনেটকার রিয়াজউদ্দীন চৌধুরী ছিলেন বড়ো লোকের ছেলে। রীতিমতো সুদর্শন, কিন্তু উচ্ছন্নে গিয়েছিলেন। যাই হোক, কারমাইকেল হোস্টেল থেকে নজরুলের পানবাগানের বাড়িতে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। সেখানে ছিলেন ওস্তাদ জমিরুদ্দীন। পরে নজরুলকে কয়েকবার দেখি ‘কল্লোল’ অফিসে। নজরুল রাঁচি থেকে লম্বা চিঠি লিখেছিলেন তাঁর “মক্তব-সাহিত্য” বইটি পাঠ্য করবার জন্য। আমি চিরকাল এলোমেলো, নজরুলের সে-চিঠি হারিয়ে ফেলেছি, রবীন্দ্রনাথের চিঠিও আমি হারিয়েছি। আমি “মক্তব-সাহিত্য” পাঠ্য করার ব্যবস্থা করেছিলাম। মিস ফজিলাতুননেসার সংবর্ধনায় নজরুলকে একবার কারমাইকেল হোস্টেলে নিয়ে এসেছিলাম আমরা।

আমার জগৎটি আলাদা ছিলো ব’লে নজরুলের সঙ্গে ঠিক ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসিনি। তিনি আমার “শিরনি” বই-এর একটি ভুমিকার মতো লিখে দিয়ে ছিলেন, তাতে লিখেছিলেন ‘ক্লারিওনেট আর তানপুরার আসরে মেঠো রাখালকে ধরে এনেছেন, আর কার কেমন লাগবে জানিনে কিন্তু আমার চোখে জল এসেছে।’

১৯৩৫ সালের পর থেকেই জয়নুল আবেদীনের খ্যাতি ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় অনেক পরে- ঢাকায়। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার প্রতিবেশী হয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ। মাঝে-মাঝে যেতাম। বাংলাদেশ ও বাঙালি সংস্কৃতির গভীরতম অনুরাগী হিশাবে তাঁকে জেনেছি।

১৩২৮-এর চৈত্রে প্রবাসীতে জসীমউদ্দিনের একটি কবিতা প’ড়ে আমি বিস্মিত এবং মুগ্ধ গিয়েছিলাম। তারপর চিঠিপত্রে আমাদের যোগাযোগ হয়। প্রথম দেখা হয় ফরিদপুরে যখন Bengal Provincial Conference হয় তখন। সে সভায় গান্ধী এসেছিলেন। নজরুল ইসলাম ও এসেছিলেন। নজরুলের “ভাঙার গান” তখন বৃটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। ঐ সভায় গোপনে বিক্রি করা হচ্ছিল বইটি। আমি এক কপি কিনেছিলাম। যাই হোক, ঐ সভাতেই জসিমউদ্দীনের সঙ্গে আলাপ, এবং ক্রমে ঘনিষ্ঠতা হয়। ‘ভারতী’তে পরে লোকগীতি সম্পর্কে জসীমউদ্দীন এবং আমার লেখা একসঙ্গে ছাপা হয়। একটা সময় ছিলো যখন জসীমউদ্দীন, আব্বাসউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা এঁরা সব একসঙ্গে থাকতেন কলকাতার লোয়ার রেঞ্জে। জসীম উদ্দীনের ডাক নাম ছিলো ‘সাধু’। সেই শ্মশানটাও দেখিয়েছিলো যেখানে গিয়ে ও  জপ করতো। জসীমউদ্দীনের বাড়িতে আমি গেছি-ওর মা-র হাতের পিঠে খেয়েছি। আমি বিয়ে করেছিলাম ফরিদপুরের রাজবাড়িতে, জসীমউদ্দীন সেখানে আমার শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলো একবার। ঐ বাড়িটার চার পাশ ছিলো পানি দিয়ে ঘেরা। একজন এসে বললো, আমাকে কে ডাকছে। গিয়ে দেখি, জসীমউদ্দীন পানির ওপারে দাঁড়িয়ে। নৌকা পাঠিয়ে দিলাম। এপারে এসে বললো, পথে আসার সময় একটা গাছের নিচে বসেছিলো কিছুক্ষণ। সেখানেই বোধহয় ওর কবিতার খাতাটি হারিয়ে ফেলেছে। জসীমউদ্দীনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল। শেষদিকে তো হাসপাতালে হাসপাতালেই থাকতো। “নকশী কাঁথার মাঠ” লিখতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলো একটা জায়গায়-বিয়ের বর্ণনায়। তখনো ও বিয়ে করেনি, কাজেই বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান জানতো না। পরে তো ফুটফুটে এক বউ বিয়ে করে আনলো। ওর প্রতিষ্ঠিত ‘সাহিত্য সাধণা সংঘে’র সভায় অনেকবার গিয়েছি।

প্র.       লালন ফকির সম্পর্কে দু’একটি মন্তব্য করবেন কি?

উ.        লালন শাহ সম্পর্কে প্রথম লিখি ১৩৩৩-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যা ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায়। তাঁর গীতিকা সংগ্রহের কাজ তো করেছিই। আমার বিশ্বাস, তাঁর বহু গান এখনো সংগৃহীত হয়নি। কেউ-কেউ বলেন, রবীন্দ্রনাথ সংগৃহীত যে-সব গান রবীন্দ্রসদনে আছে সেগুলোই খাঁটি-অন্যগুলো নয়। আমি এটা বিশ্বাস করি না। লালন শাহের শিষ্যেরা অনেকেই তাঁর গান লিখে রাখতেন। লালনের ভাষায় যখন তার ‘পোনা মাছের ঝাঁক’ আসতো অর্থাৎ আবেগের বান ডাকতো, তখন তিনি গানগুলি শিষ্যদের শিখিয়ে দিতেন। পরদিন আবার শুনতেন। এবং ভুল হ’লে সংশোধন করতেন। সুতরাং রবীন্দ্র-সদনের বাইরেও অনেক জায়গায় খাঁটি লালন-গীতি পাওয়া যেতে পারে।

আমার ইচ্ছা ছিলো ‘Corpus of Lalon Shah’ প্রণয়ন করা। লালন-গীতির বিভিন্ন পাঠ মিলিয়ে একটি Composite Text তৈরি করা। সে সব সম্পদনা-কাজের সময় আর পাবো না। লালন-গীতির যে-তরজমা করেছেন ব্রাদার জেমস, কবীর চৌধুরী তা দেখে দিয়েছেন, শিগগির বেরোবে। শুনেছি ভারত সরকার লালন-গীতির স্বরলিপি প্রণয়নের একটি প্রকল্প গ্রহণ করছেন। যদি তা হয় তাহ’লে এখান থেকেই গানের টেপ নিলে সুরের শুদ্ধতা অধিক রক্ষিত  হবে-কেননা পশ্চিমবঙ্গে এবং এখানেও অনেক সময় লালন-গীতির সুরবিকৃতি ঘটছে।

লালন ফকির সম্পর্কে সম্প্রতি ব্যাপকভাবে গবেষণা হচ্ছে। কোথাও-কোথাও পরস্পরবিরোধী মতামতও। এসব থেকে প্রকৃত সত্য একদিন বেরিয়ে আসবে। আমি আশাবাদী।

ব্যানার ছবি: সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও কবি বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply