ঈশাপুরের পর্তুগিজ মহিলা জমিদার অরাদ্য বারোজ

আবদুল হক চৌধুরী

পলাশী যুদ্ধের পর মীরজাফর ইংরাজ কর্তৃক বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব পদে নিযুক্ত হয়। পরে তাঁকে পদচ্যুত করে তদীয় জামাতা মীরকাসেমকে নবাব পদে নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখের চুক্তির শর্ত মোতবেক ইংরাজ সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বর্ধমান মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের রাজস্ব উসুলের দায়িত্ব প্রদান করেন। কোম্পানি ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি তারিখে মিঃ হ্যারি ভেলস্টকে চট্টগ্রামের চিফ পদে নিযুক্ত করে। কোম্পানির আমলেই এ জিলায় রাজস্ব বৃদ্ধির মানসে জরিপ প্রবর্তন, সুলতানি ও নবাবি আমলে প্রদত্ত লাখেরাজ মদদ-ই-মায়েস প্রভৃতি খাতের জমি বাজেয়াপ্ত করে ও প্রাচীন রাজস্ব আদায়ের প্রথা রহিত করে পঁচিশ জন জমিদারের উপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন পর্তুগিজ খ্রিস্টান, এরা মদদ-ই-মায়েস লাভ করেন। পরবর্তীকালে আরো দুজন ইংরেজ দুইটি জমিদারি পত্তনি নেয়। এই চারজন খ্রিস্টান জমিদার হলেন:

১। পর্তুগিজ কেপ্টেন হাবার্ট সাদারল্যান্ড নামক একব্যক্তি ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে কুতুবদিয়া দ্বীপ খয়রাত-ই-মদদ-ই মায়েস জীবিকা নির্বাহের জন্য নিষ্কর লাভ করেন।(১)

২। আন্দর ফর্নাদ (Ander Fernands) নামক এক পর্তুগিজ ঈশাপুর পরগণায় জমিদারি লাভ করেন। এই পর্তুগিজ জমিদার বংশের শেষ মহিলা জমিদার আওরাদে বারোজ এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।(২)

৩। বিবি মেরি স্পার্কস নামক জনৈক মহিলা ১৭৬৬ খ্রিস্টব্দে চকরিয়া থানার পহর চাঁদায় বিরাট জমিদারি লাভ করেন।(৩)

৪। রবার্ট ওয়েব ল্যাজ নামক ব্যক্তি ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে মহেষখালি দ্বীপ জমিদারি লাভ করেন।(৪)

মধ্যযুগে চট্টগ্রামে বণিক ছদ্মবেশী পর্তুগিজ বোম্বেটেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও দৌরাত্মের কাহিনী ইতিহাসের পাঠক মাত্রেরই অল্পবিস্তর জানা আছে। তারা আরাকানরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামের ধনসম্পদ লুন্ঠন ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষের উপর নির্বিচারে জোর-জুলুম চালিয়ে যে অমানুষিকতার পরিচয় দিয়েছিল, এ দেশের জনসাধারণ তাই সমসাময়িককালে পর্তুগিজদের হারমাদ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। হারমাদদের অত্যাচারের কাহিনী  ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে, আর তার বাস্তব চিত্র বিধৃত আছে সমসাময়িককালের সত্য ঘটনা অবলম্বনে চট্টগ্রামের নিরক্ষর পল্লিকবিদের রচিত নূরন্নেহার ও কবরের কথা, নছর মালুম প্রভৃতি পালাগানে (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ গীতিকা)।

পর্তূগিজদের চট্টগ্রাম আগমনের পরবর্তীকাল থেকে চট্টগ্রামি ভাষায় জোরজুলুম অর্থে ‘হারমাদ্যাই’ শব্দটি (হারমাদ শব্দ থেকে উদ্ভব) হয়েছে। চট্টগ্রামে কেউ কারো নিকট থেকে কোন কিছু জুলুম-জবরদস্তি কেড়ে নিলে বা নিতে চাইলে তাকে হারমাদ্যাই করা অর্থাৎ পর্তুগিজদের মত জোর-জুলুম করে নেয়া বলা হয়।

চট্টগ্রামে আগমনকারী পর্তুগিজদের মধ্যে কিছুসংখ্যক বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন ভাল লোকও ছিলেন। ডক্টর আহমদ শরীফ এতিম কাসেম বিরচিত আওরা দ্যা বারোজ  প্রশস্তির ভূমিকায় লিখেছেন পর্তুগিজ বণিকদের কিছুসংখ্যক লোক চট্টগ্রামে জমি খরিদ করে মালামালের আড়ত, চাষাবাদ করাতেন এবং প্রজাপত্তনি দিতেন; সেই সূত্রে জমিদারির মালিক হতেন। উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত সুবিখ্যাত প্রাচীন ঈশাপুর পরগণায়ও তেমনি একটি পর্তুগিজ পরিবার চারপুরুষ ধরে জমিদার ছিলেন। ঈশাপুর পরগণার কবি এতিম কাসেম আওরাদ বারোজ প্রশস্তি নামক ক্ষুদ্র কাব্যখানি (রচনাকাল ১৭৭৫-৮০ খ্রিস্টাব্দ) এই পর্তুগিজ বংশীয় মহিলা জমিদারের কৃপালাভের আশায় তাঁর প্রশংসা ও তোয়াজ করে রচনা করেছিলেন। উক্ত কাব্যে বর্ণিত জমিদার আওরাদে বারোজ ও তদীয় শ্বশুরকুলের পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে:

সে বংশে জনম এক              আওরাদে বারুচ পরতেক

সে বংশেত জন্ম আসি ভেল।

আল্লাহ কৃপার ফলে               জন্মিয়াছে মহীতলে

তানকীর্তি দেশান্তরে গেল।।

আল্লার হুকুম হৈল               ভাগ্য আসি প্রবেশিল

আদ্যে লেখা আল্লার ফর্মান।

ঈশাপুর দেশে আসি              প্রকাশিল যেন শশী

তিতানান্নে–পতি হৈল তান।।

এবে তিতানান্নে বাণী             শুন সবে মনে জানি

কহিবম কাহার তনয়।

আন্দর ফর্নাদসুত                কালুচ ফর্নাদ যুত

তান পুত্র তিতানান্ন হএ।।

তানগর্ভে উতপন-               সৃজিয়াছে নিরঞ্জন

রুপজিনি চন্দ্রিমা সমান।

বয়স না হইতে নিধি             হরিয়া নিলেক বিধি

তিতানান্ন হইল নির্ধন।

আপনা পতির যথ               মাল সিল্লিক (মুল্লুক যথশত)

তানদস্তে হইল সমর্পন।(৫)

 

মাহবুব-উল-আলম সাহেব চট্টগ্রামের ইতিহাস ৩য় খন্ড কোম্পানী আমলের ৪৮ পৃষ্ঠায় আওরাদে বারোজ পরিচিতি প্রসঙ্গে লিখেছেন : তিনি প্রথমে বিয়ে করেন সুইডেনবাসী চার্লেস এডমানকে অতঃপর ডিয়েডরিচ মার্কোয়াডকে। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের এক রিপোর্টে জানা যায় যে এডমান বার্ষিক নয় হাজার টাকা আয়ের জমির মালিক হইয়া বসিয়াছেন। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে অরাদ্য বারোজের মৃত্যু হইলে মার্কোয়াড তাহার প্রচুর ভূসম্পদের মালিক হন। জোয়ান দ্য বারোজ নামে তার এক ভাই ছিল। চট্টগ্রাম জিলার প্রধান পর্তুগিজ পরিবার ফ্রীটাসদের সহিত দ্য বারোজদের আত্মীয়তা ছিল। উপরোক্ত সূত্র দুটো ও আমাদের সংগৃহীত তথ্যের সাহায্যে নিম্নে আওরাদে বারোজ পরিচিতি লিপিবদ্ধ করলাম। ঈশাপুর পরগণায় সর্বপ্রথম যে পর্তুগিজ বণিক  জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার নাম হলো আন্দর ফর্নাদ (Ander Farnandes) । তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলে তৎপুত্র কালুচ ফর্নাদ (Caluch Fernandes) পৈত্রিক সূত্রে উক্ত জমিদারির মালিক হয়েছিলেন। তিনি পরিণত বয়সে পরলোকগমনের পর তার একমাত্র পুত্র তিতানান্ন এই জমিদারির মালিক হন। কিন্তু তিনি অল্প বয়সে নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোকগমন করেন। তখন তার বিধবা পত্নী আওরাদে বারোজ ঈশাপুর পরগণার জমিদারির মালিক হন। অতঃপর তিনি সুইডেনবাসী চার্লস এডমানকে দ্বিতীয় স্বামীরূপে গ্রহণ করেন। সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পর ডিয়েডরিচ মার্কোয়াড নামক এক ব্যক্তিকে আওরাদে বারোজ তৃতীয়বার স্বামী গ্রহণ করেছিলেন।

আওরাদে বারোজ অত্যন্ত দয়ালু ও প্রজাবৎসল জমিদার ছিলেন। প্রজাদের প্রতি তাঁর দয়া-দক্ষিণ্যের কথা ঈশাপুর পরগণার প্রাচীন ব্যাক্তিদের মুখে আজো কিংবদন্তীরূপে প্রচলিত আছে। তিনি প্রজাদের নিকট বিবি নামে খ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর বার হাজার প্রজা ছিল। তাঁর জমিদারি পরিচালনা করতেন দেওয়ান দেবী দাস। এবং জমিদারি সেরেস্তার অন্যান্য কর্মচারি ছিলেন রামদুলাল, জয়নারায়ণ, রামভদ্র ঠাকুর, মোহাম্মদ খোসাল, আজিজ উল্লাহ, হিস্মত উকিল ও তিতা গাজী এবং অনেক পাইক-পেয়াদাও ছিলো।

আওরাদে বারোজের জমিদারি ছাড়া ব্যবসা-বানিজ্যও ছিল। তিনি চট্টগ্রামি কারিগরদের দ্বারা জাহাজ নির্মাণ করিয়ে দেশে বিদেশে পন্যদ্রব্য বানিজ্য উপলক্ষে পাঠাতেন। প্রাচীণ ঈশাপুর পরগণার জাঁহাপুর ফতেপুর গ্রামে আরকানি আমলে নির্মিত মাটির দূর্গ কোট-এর উত্তর-পশ্চিম কোণের মধ্যে একটি দিঘি খনন করেছিলেন। সেটা এই এলাকার জনসাধারনের নিকট বিবির দিঘি নামে সুপরিচিত।

এই দিঘি সংলগ্ন কোটের পশ্চিম পাড়ের বাইরে অবস্থিত ছিল আওরাদে বারোজের জমিদারি কাছারি ও কুঠিবাড়ি। তা বর্তমানে নিশ্চিহ্ন হয়ে নাল জমিতে পরিণত হয়েছে। এই জমি এখনো কাছারি ভিটা নামে খ্যাত হয়। বর্তমানে বিবির দিঘির পাড় কেটে নাল জমি করা হয়েছে। শুধু মধ্যে জলীয় অংশের কিছু অবশিষ্ট আছে। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর সময় তাঁর নামে তরফ আর.ডি. বারোজ নামে খ্যাত একটি তরফ সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তদীয় উত্তরাধিকরী ৩য় স্বামী ডিয়েডরিচ মার্কোয়াড উক্ত জমিদারির মালিক হন। তিনি উক্ত তরফ ফরিদপুরবাসী জমিদার নিত্যানন্দ কুণ্ডর নিকট বিক্রি করে দেন। ডক্টর আহমদ শরীফের মতে তাঁর শুদ্ধ নাম Aorade Barrose। জনাব মাহবুব-উল-আলমের মতে অরাদ্য বারোজ কিন্তু তার নামীয় তরফের আর. এস. জরিপের খতিয়ানে আর.ডি. বারোজ রূপে তাঁর নাম মুদ্রিত আছে।

কুণ্ডবাবুদের জমিদারি কাছারি ছিল বর্ণিত কোট-এর দক্ষিণ পাড়ে। তাদের কাছারি এলাকার পাকা ভবনটি পর্তুগিজ আমলে তৈরি ভবনের মত দেখতে খুব উঁচু। সম্ভবত এই ভবনটি এই পর্তুগিজ জমিদার পরিবারের আমলে তৈরি। কোটের দক্ষিনপারে কুণ্ডবাবুরা জমিদারি কাছারি ছাড়া দাতব্য চিকিৎসালয়, ডাকঘর, ডাকবাংলা ইত্যাদি জনহিতকরমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। কোটের অগ্নিকোণে একটি দিঘি খনন করিয়েছিলেন। সেটা এখন কুণ্ডর দিঘি নামে খ্যাত হয়। এখন জমিদারি নেই, কুণ্ডদের উত্তরাধিকারীরা ভারতীয় নাগরিক। এখানকার ডাক্তারখানা, ডাকঘর ইত্যাদি আজো কুণ্ডদের নামে খ্যাত হয়। তরফ আর.ডি. বারোজের খরিদমূলে মালিক জমিদার বাবু নিত্যানন্দ কুণ্ডর গুনগান করে উনবিংশ শতকের ঈশাপুর পরগণার নানুপুর গ্রামের কবি আজগর আলী পণ্ডিত তদীয় কাহিনীকাব্য চীন লেস্পতিতে (রচনাকাল ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) বর্ণনা করেছেন:

 

জেলা সহর চট্টগ্রাম               ইছাপুর পরগনা নাম,

মহাত্মা সকল করে বাস।

আমিরী কবিরী শান              ধনে জনে পূজ্য মান,

সদা…হাবিলাস।।

রাজ্যের ঈশ্বর ভাল               নিত্যানন্দ মহীপাল,

পূত্র ন্যায় পালে প্রজাগন।

ন্যায় বন্ত অতি ধীর              ধর্মে কম্মে যুধিষ্ঠীর,

দানে জিনি কুন্তির নন্দন।।

সপ্ত মৌজা ইছাপুর               উত্তর সে নানুপুর,

সাধু মান্য সতত সঞ্চয়।

সর্ব লোক এক মতি              কর জোগাওন্ত নিতি

মহিপালে আদরে তোষয়।।

 

কবি তোয়াজের ভাষায় জমিদার নিত্যানন্দ কুণ্ডকে রাজা এবং ঈশাপুর পরগণাকে রাজ্যরূপে বর্ণনা করেছেন।

তথ্যপুঞ্জি

১. পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস, ১ম খন্ড, ২য় ভাগ, পৃ. ৪৬।

২. বাংলা একাডেমি পত্রিকা,ভাদ্র-চৈত্র, ১৩৬৫ বাংলা, পৃ. ২৭।

৩. মাহবুব-উল-আলম, চট্টগ্রামের ইতিহাস কোম্পানী আমল, পৃ. ৮৩-৮৪।

৪. পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস, ১ম খন্ড, ২য় ভাগ, পৃ. ৪৮।

৫. বাংলা একাডেমি পত্রিকা,ভাদ্র-চৈত্র, ১৩৬৫ বাংলা, পৃ. ৩৫।

আবদুল হক চৌধুরী (১৯২২-১৯৯৪) চট্টগ্রামের ইতিহাস রচনার একজন পথিকৃৎ। তিনি চট্টল তত্ববিদ হিসেবে খ্যাত ছিলেন। 

সুত্র: আবদুল হক চৌধুরী, প্রবন্ধ বিচিত্রা : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বাংলা একাডেমী : ১৯৯৪

ব্যানার ছবি: কর্ণফুলী নদীর তীরে পর্তুগীজ-আরাকানি শক্তির সাথে মুঘলদের লড়াইয়ের একটি চিত্র। ঘটনার সময়কাল ১৬৬৬। সুত্র: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাদুঘর

ফিচার ছবি: ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে চট্টগ্রামে পর্তুগীজদের প্রতিষ্ঠিত চার্চ ।

Leave a Reply