ফজলুল হক সাহেবের রিভলবার চুরি

মুজফফর আহমদ
নবযুগে কাজ করার সময়ের আর একটি গল্প বলি। ১৯২০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত খেতাবধারীরা ( যেমন রায় সাহেব, খান সাহেব, রায় বাহাদুর, খান বাহদুর ইত্যাদি) এবং আইন সভার সভ্যরা লাইসেন্স ছাড়াও অস্ত্র কিনতে ও রাখতে পারতেন। আমার ঠিক মনে নেই, সম্ভবত অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটরাও ওই ভাবে অস্ত্র রাখার অধিকারী ছিলেন। এ.কে. ফজলুল হক সাহেব আইন সভায় সভ্য ছিলেন। সেই অধিকারে তিনিও একটি রিভলবার কিনেছিলেন, কিন্তু সেটি রাখার যে ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন তা অত্যন্ত চমৎকার । বাড়ীর নীচেরতলায় একটি স্টিল ট্রাঙ্কে তিনি তাঁর অস্ত্রটি রেখেছেলেন।এই ট্রাঙ্কের তালা কখনও বন্ধ করা হতোনা।

১৯১৯ সালের ভারতীয় শাসন সংস্কার আইন চালু হওয়ার পরে গবর্ণমেন্ট একটি হুকুম এই বলে জারী করলেন যে যাঁদের নিকট লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র আছে তাঁদের লাইসেন্স করিযে নিতে হবে। এই সময় ফজলুল হক সাহেবের মনে পড়ল তাঁরও একটি রিভলবার আছে, লাইসেন্স করিয়ে নেওয়া দরকার। তালা বন্ধ -না-করা ট্রাঙ্কটির ডালা তুলে তিনি অস্ত্রটি পেলেন না। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পুলিসে খবর দিলেন। তার পরে শুরু হলো সাদা পোশাকওয়ালাদের আনাগোনা।

নজরুলকে আর আমাকে দু’চার কথা তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু সেটা তেমন কিছু নয়। তবুও ওই বাড়ীতে তাঁদের আসা যাওয়া কিছুতেই বন্ধ হলো না। খোলাখুলিভাবে না বললেও তাঁদের মনে সন্দেহ হয়েছিল যে নজরুল ইসলাম আর আমি অস্ত্রটি সরিয়েছি নজরুলের ওপরেই তাঁদের সন্দেহ হয়েছিল বেশী। কারণ পুলিসের ধারণা জন্মেছিল যে আর্মি ফেরৎ ওই রকম একটি জওয়ান ছেলে অস্ত্রটি চুরি না করেই পারেনা। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট মুহম্মদ ইউসূফ ফজলুল হক সাহবের সঙ্গে দেখা করার অছিলায় বসেই থাকতেন। এই ভাবে অনেক দিন ঘোরাঘুরি করার পরে সাদা পোশাকওয়ালারা আসা বন্ধ করে দিল। বলা বাহুল্য ফজলুল হক সাহেবের বাড়ির নিচের তলায় নবযুগের অফিস ছিল প্রেস ছিল অন্য বাড়ীতে।

ফজলুল হক সাহেবের একটি ছোকরা চাকর ছিল। সে বয়:সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছিল। সেই সময়ে যৌবনাগমনের কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের বাসনায় তার মনে জাগা অস্বাভাবিক ছিল না। তার জন্যে টাকা চাই। ফজলুল হক সাহেবের দুই ভাগিনেয় ওয়াজির আলী সাহেব ও ইউসফ আলী সাহবে সহ আমাদের মনে সন্দেহ হয়েছিল যে ছোকরা চাকরটিই রিভলবার সরিয়েছিল। টার্ণার স্ট্রীটে অনেক এংলো ইন্ডিয়ানের বাস ছিল। তাঁদের ভিতর কিছু লোক চোরাই অস্ত্রের ব্যবসায় করত। কাজেই, সেই ছোকরা চাকরের পক্ষে অস্ত্র বিক্রয় কোনো অসুবিধা ঘটেনি। এক বা একাধিক এংলো ইন্ডিয়ানদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে সে এই কাজ করতে পারে। কিন্তু পুলিশ ওই দিকটাতেই ঘেষল না। সাধারণ ক্রিমিনালদের পেছনে ছোটাছুটি করলে পলিটিক্যাল পুলিসের ইজ্জৎ থাকবে কেন? সেই কাজের জন্য তো আলাদা পুলিশ আছে। তা ছাড়া, সন্দেহ তো বিশেষভাবে নজরুলের ওপরে হয়েছিল।

মুজফফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩) ছিলেন অবিভক্ত ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ

সুত্র : মুজফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম:  স্মৃতিকথা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৭৫ ( ৪র্থ মুদ্রণ)

ব্যানার ছবি: মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম

Leave a Reply